বিশেষ প্রতিবেদকঃ এমন নয় যে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বিরুদ্ধে অনুযোগ ছিল না, কিন্তু সেই অনুযোগ কিংবা অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে পরিণত হয়নি বা ঝড়ে পরিণত হতে পারে। অভিযোগ ছিল বেকারির, মূল্যবৃদ্ধির, কৃষক সমস্যার, করোনাকালে সরকারি অব্যবস্থার। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জেলায় কান পাতলে শোনা যেত এই সব অভিযোগ অনুযোগের কথা। এবং এই সব কারণেই ভোটারের একটা অংশ বিজেপিকে ভোট দেয়নি বলেই বিজেপি ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যে ৩০০’র উপরে আসন পেয়েছিল, সেটা এবার ধরে রাখতে পারেনি। তথাপি ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ক্ষমতায় আসার পথে সেটি বাধা হয়ে দাড়ায়নি। এর অবশ্যই অনেকগুলি কারণ আছে।
কারণ-১
২০২২ সালের নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে কিংবা মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে দৃশ্যতা কোনও প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া পরিলক্ষিত হয়নি। এটা সত্যি আশ্চর্য্যর, যে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও উত্তরপ্রদেশের ভোটারদের এক বিরাট অংশ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির কিংবা অন্য কোনও গুরুতর অভিযোগ তোলেননি, তাদের অভিযোগ ছিল, সরকারি আধিকারিক এবং আমলাদের বিরুদ্ধে কিন্তু মানুষের সিংহ ভাগ আদিত্যনাথকে কাঠগড়ায় তোলেননি, তাই তারা দরাজ হাতে ভোট দিয়ে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন আদিত্যনাথকে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায়।
কারণ-২
উত্তরপ্রদেশের অধিকাংশ মানুষই রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে মহিলারা, মাফিয়া রাজ উত্তরপ্রদেশে শেষ করে দেওয়ার প্রচারেও সুক্ষভাবে লুকিয়ে ছিল মাফিয়াদের সাম্প্রদায়িকীকরণ। বার বার ভোটের প্রচারে আদিত্যনাথ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, আতিক আহমেদ, মুখতার আনসারির মতো মুসলিম মাফিয়াদের জেলে ঢোকানোর কথা। এই প্রচার স্বাভাবিকভাবেই দাগ কেটেছে হিন্দুভোটারদের সঙ্গে আদিত্যনাথের সরকার ক্ষমতায় না এলে, এই মুসলিম মাফিয়ারা ফের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সারা রাজ্যে দাপিয়ে বেড়াবে, এই আশঙ্কার কথা ভোটারদের এক বড় অংশের সঙ্গে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল বিজেপি।
কারণ-৩
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো জনপ্রিয়তা হলেও, রাজ্যে মোটামুটি জনপ্রিয় ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ, বিশেষ করে নিরাপত্তা এবং বিজেপির কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির জন্য। এর ফলে মহিলাদের এক বিরাট অংশের ভোট পেয়েছে বিজেপি।
কারণ-৪
করোনার সময় এবং করোনা পরবর্তীকালে বিজেপি সরকারের কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি বিশাল প্রভাব ফেলেছে উত্তরপ্রদেশের ভেটারের উপর বিশেষ করে দরিদ্র ভোটারদের উপর। এই নির্বাচনে বিজেপি নিজেদের পক্ষে এক নতুন এবং বিশাল ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে যাদের বলা হচ্ছে লাভার্থী বা সুবিধাভোগী, বিজেপি সরকার তাদের এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ৫ কিলো করে খাদ্যশস্য বিতরণ করেছে। মানুষের হাতে দেওয়া হয়েছে নগদ টাকা। যারা কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির মাধ্যমে সুবিধা পেয়েছেন সেই লাভার্থী বা সুবিধাভোগীর সংখ্যা উত্তরপ্রদেশে প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ। এদের নাম সংগ্রহ করে এদের বাড়ি বাড়ি হিয়ে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্য প্রচার চালিয়েছেন দলের কর্মীরা। এতবড় প্রচার অভিযান বহু আগেই শুরু করেছিল বিজেপি যার প্রতিফলন দেখা গেছে বিজেপির ভোটবাক্সে। ধর্ম, বর্ণ ও জাতি নির্বিশেষে বিজেপির কল্যাণমূলক সামাজিক প্রকল্পগুলির সুবিধা পেয়েছেন সব মানুষ বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে।
কারণ-৫
গুজরাতের পর উত্তরপ্রদেশকে হিন্দু প্রয়োগশালা গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছিল বহু আগেই সংঘ পরিবার। সেই কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন যোগী আদিত্যনাথ। এই নির্বাচনে পণ্ডিতরা বলছেন যে বিজেপির কোনও সাম্প্রদায়িক ইস্যু কার্য়কর হয়নি। কিন্তু তার প্রয়োজন ছিল না। বিজেপি বিগত পাঁচ বছরে হিন্দুদের মধ্যে তাদের হিন্দু পরিচিতিকে এমনভাবে জাগিয়ে তুলেছে যা তাদের অস্তিত্বের এক প্রধান অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে ভোট দেওয়ার সময় ভোটারের হিন্ধু পরিচিতি অন্যান্য সমস্যাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে অযোধ্যার রাম মন্দিরের নির্মাণ, কাশি বিশ্বনাথ করিডোর এবং মথুরার মন্দিরের ইস্যু।
কারণ-৬
তাছাড়া বিগত পাঁচ বছরে পরিকাঠামো নির্মাণেও সাফল্য দেখিয়েছে আদিত্যনাথের সরকার। নতুন নতুন পুল, সড়কপথ নির্মাণ ইত্যাদি প্রভাব ফেলেছে ভোটারদের উপর।
কারণ-৭
এই নির্বাচনে মায়াবতীর সঙ্গে বিজেপির সঙ্গে কোনও গোপন বোঝাপড়া হয়েছিল কি না সেটা না জানা গেলেও আশ্চর্য্যজনকভাবে এইবার মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেখা যায়নি, যদিও মায়াবতীর পশ্চাদপদ শ্রেণির ২৩ শতাংশ ভোট এতদিন অটুট ছিল উত্তরপ্রদেশে। কিন্তু নির্বাচনী লড়াইয়ে মায়াবতী সেভাবে না থাকায় তার ভোট ব্যাঙ্ক, কুশওয়াহা, মৈনি এবং অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণির ভোট বিভাজিত হয়েছে বিজেপি এবং সমাজবাদী পার্টির মধ্যে। তবে এই সব ভোটের বড় অংশ পেয়েছে বিজেপি কারণ সরকারের কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির সুবিধাভোগী এই সমাজের মানুষও। মুসলিম এবং জাটেরা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টিকে ভোট দিয়েছে বলেই গতবারের ৪৪ আসন থেকে অখিলেশ যাদবের আসন সংখ্যা ১০০ পেরিয়ে গেছে। কৃষক আন্দোলনের প্রভাব সেভাবে পড়েনি ভোটে।