পুবের কলম প্রতিবেদক: বাংলার মুসলমানদের হৃদয়ের মণিকোঠা জুড়ে যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, সেই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সরানোর জন্য যেসব কান্ড হয়েছে, তা অনেকেরই জানা। বর্তমানে সেই প্রচেষ্টা খানিকটা শিথিল হলেও পুরোপুরি স্তিমিত হয়নি। অপেক্ষা করা হচ্ছে বর্তমান উপাচার্য কার্যকালের মেয়াদ কবে শেষ হবে। হিসেব অনুযায়ী তা এপ্রিল মাসে হওয়ার কথা।
কিন্তু এ’ন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্টারের সরানোর জন্য কলকাতাকেন্দ্রিক প্রভাবশালী একটি মহল উঠে পড়ে লেগেছে। তাঁর অপরাধ কি সে সম্পর্কে কিছু জানা যাচ্ছে না। কিন্তু নবান্ন থেকে এমএএমই দফতরের স্পেশাল সেক্রেটারি এক চিঠি (NO ৩১৬ MD ১১০১৮/৮/২০১৯ ,DATE – ২৩.০২.২০২২) দিয়ে আলিয়ার উপাচার্যকে বলেছেন, রেজিস্টারার ড. সৈয়দ নুরুস সালাম যেন ২৮/০২/২০২২-এর মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে স্কুল এডুকেশন দফতরে ফিরে যান।
সেইসঙ্গে আরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ২৮/০২/২০২২-এর পর থেকে রেজিস্টারার ড. সৈয়দ নুরুস সালাম-এর বেতন ও ভাতা যেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর তা সুনিশ্চিত করার জন্য আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অফিসারকেও এই নির্দেশ পালনের জন্য কড়া আদেশ দেওয়া হয়েছে।
আসলে ড. সৈয়দ নুরুস সালাম-কে রেজিস্টারার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া জন্য বেশ কিছুদিন ধরে যে চেষ্টা চলছে, তারই পরিণতিতে এই চিঠি।
কিন্তু আলিয়ার বিগত ইসি-র বৈঠকে প্রস্তাব নেওয়া হয়, ড. সৈয়দ নুরুস সালাম রেজিস্টারার পদে সন্তুষ্টিজনকভাবে কাজ করছেন। তাই তাঁকে স্থায়ীভাবে রেজিস্টারার করা হবে, যদি চলমান একটি মামলায় তাঁর পক্ষে রায় দেওয়া হয়। পরে সুপ্রিম কোর্ট ওই মামলায় ড. সৈয়দ নুরুস সালাম-এর রেজিস্টারার হিসেবে নিয়োগ বৈধ বলে ঘোষণা করে। তাই ইসি-র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ড. সৈয়দ নুরুস সালাম স্থায়ীভাবে রেজিস্টারার হয়েছেন।
ইসি-র ওই সিদ্ধান্ত থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হল: Resolution:Resolved that the confirmation of service of Dr Syed Nurus Salam as registrar may be deferred for the time being as a Court Case is pending, but he will continue as usual.Further resolved that his service will be confirmed automatically if the court case is disposed off in favour of him as he has been working satisfactory.
এছাড়া আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ২০/০১/২০২২ তারিখে ড. সৈয়দ নুরুস সালাম-কে এক পত্রযোগে( NO: AU/VC/004/22) জানিয়েছেন, ২১/০৭/২০২০ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার (AU/VC/ 096(05) /২০২০, DATED – ০৩/০৭/২০২০) অনুযায়ী আপনি রেজিস্টারার হিসেবে যোগদান করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা থাকায় ৫ আগস্ট ২০২১ সালে আলিয়ার এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের ১৫তম বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আপনি খুবই সন্তোষজনকভাবে কাজ করছেন। তাই মামলাটির রায় আপনার পক্ষে গেলে আপনি স্বয়ংসিদ্ধভাবে রেজিস্টারার পদে স্থায়ী হবেন।
যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট আপনার পক্ষে রায় দিয়েছে তাই ইসি-র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপনার চাকরি স্থায়ী করা হল। ভিসি-র এই চিঠি অনুযায়ী ড. সৈয়দ নুরুস সালাম স্থায়ীভাবে আলিয়ার রেজিস্টারার পদে বহাল রয়েছেন। তাই তাঁর বেতন ও ভাতা বন্ধ করার জন্য নবান্নের এমএএমই দফতরের স্পেশাল সেক্রেটারি যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা ‘অবৈধ’ বলে অনেকেই মনে করছেন।
স্কুল শিক্ষা দফতরে ফিরে গেলে বা কর্মরত থাকলে ড. সৈয়দ নুরুস সামালকে ৬০ বছর বসে অবসর নিতে হত। কিন্তু এখন যেহেতু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারার পদে কর্মরত রয়েছেন, তাই তাঁর অবসরের মেয়াদ আরও দু’বছর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি হয়েছে। তাঁর ৬২ বছর বয়স হলে সরকারি নতুন নিয়ম অনুসারে তিনি অবসর গ্রহণ করবেন।
এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখযোগ্য ড. সৈয়দ নুরুস সালাম সাহেব যিনি স্কুল শিক্ষা দফতর থেকে লিয়েন-এ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন, তিনি স্কুল শিক্ষা দফতরে তাঁর যে চাকরি ছিল তা থেকে পদত্যাগ করে এক পত্র বিশ্ববিদ্যালয় মারফত পাঠিয়ে দেন। কারণ, আলিয়ার ইসি-র প্রস্তাব অনুযায়ী, তিনি রেজিস্টারার পদেই স্থায়ী হয়েছেন।
অবশ্য, উচ্চপদস্থ এক আমলার চাপে স্কুল শিক্ষা দফতর থেকে ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ এক পত্র লিখে বলা হয়, ড. সৈয়দ নুরুস সালাম যেন শিক্ষা দফতরে ফিরে আসেন। এর উত্তরে ২৫/০২/২০২২ তারিখে এক চিঠি লিখে ড. সৈয়দ নুরুস সালাম শিক্ষা দফতরকে জানান, কি কি কারণে তিনি আর স্কুল শিক্ষা দফতরে ফিরে আসতে পারবেন না। তিনি তাঁর স্থায়ী চাকরি অর্থাৎ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্টারার পদেই বহাল থাকতে ইচ্ছুক। নুরুস সালাম তাঁর চিঠিতে এও বলেছেন যে, এটা করতে গিয়ে তিনি কোনও সার্ভিস রুলস লঙ্ঘন করেননি। পরিস্থিতি বর্তমানে এখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখন দেখতে হবে এই বিষয়ে এমএএমই নতুন কি পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের আরও উন্নতি এবং পরিকাঠামোগত বিকাশ। সেদিকে নজর না দিয়ে পরিচালকবৃন্দ তুচ্ছ কাজিয়াতেই যদি মেতে থাকেন, সেক্ষেত্রে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ যে ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মতোই হয়ে থাকছে তাতে সন্দেহ নেই।
এছাড়া শিক্ষক, অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আরও প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি-র বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি (ভিজিলেন্স) হয়েছিল। তার রিপোর্টও সংখ্যালঘু দফতরে জমা পড়েছে। কিন্তু জানা যাচ্ছে না, বর্তমান ভিসি কি কোনওভাবে দোষীসাব্যস্ত হয়েছেন, না তিনি বেকসুর বলে প্রমাণিত হয়েছেন? ফলে একটি ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভানুধ্যায়ীরা বলছেন, এসব কূট-কাচালি ও প্রশাসনিক দ্বন্দ থেকে মুক্ত হয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আবার পড়াশোনা ও গবেষণার কাজে পুরোপুরি নিজেকে নিয়োজিত করুক। আর তা হলেই যে উদ্দেশে এই ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হবে।