সম্প্রতি মোদিজি দেশের হিন্দুদের গর্বিত করে কাশী বিশ্বনাথ করিডর ও মন্দিরের বিস্তার ও সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প উদ্বোধন করলেন। কিন্তু তিনি এখানেই থেমে থাকেননি। বরং ভোটের মুখে তাঁর বেনারস বক্তৃতায় বিভাজনেরও চেষ্টা করেছেন। নিয়ে এসেছেন বাদশাহ ঔরঙ্গজেবকে। সমগ্র বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন আহমদ হাসান ইমরান
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে কাশী বিশ্বনাথ ধাম করিডর নির্মাণ ও সংলগ্ন বিশাল এলাকার উন্নয়নের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ করেছেন– তা ভারত জুড়ে বেশকিছু মহলে অভিনন্দিত হয়েছে। এজন্য ৫ হাজার হেক্টর জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছে। মন্দির ও মন্দির চত্বরের শিল্পসম্মত উন্নয়ন এবং পার্শ্ববর্তী বিরাট এলাকার সৌন্দর্যায়নের জন্য ৩৩৯ কোটির বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে এবং আরও হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি ঘোষণা করেছেন– কাশী ধাম মন্দির উন্নয়নের এটা প্রথম পর্যায় মাত্র। কাশী ধাম মন্দিরে ধাপে ধাপে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়েও উন্নয়ন হবে। মোদির এই পরিকল্পনা হিন্দুত্বে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ খুশি হয়েছেন। আর ভারতের প্রায় সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেল সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মোদির এই বারাণসী যাত্রার খবর ও ছবি লাইভ সম্প্রচার করেছে।
মোদিজি এই করিডর নির্মাণ ও মন্দির এলাকার উন্নয়নের পুরোপুরি ফায়দা নিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যা স্বভাব– কাশী-বারাণসীর মতো পুণ্যস্থানে এসেও তিনি মন-মস্তিষ্ক থেকে বিদ্বেষ মুছে ফেলতে পারেননি। শিবঠাকুর একটু ভোলা মনের দেবতা হিসেবে পরিচিত। মোদিজি কিন্তু ইতিহাস ভোলেন না। অবশ্য এটা ভিন্ন কথা যে– এই ইতিহাসে তাঁর মনের মাধুরি মিশে রয়েছে। এই পবিত্র মুহূর্তেও উনি খামোখা টেনে আনলেন মুহি-উদ-দিন মুহাম্মদ ঔরঙ্গজেবকে। মোদি বলেন– ‘যখনই কোনও ঔরঙ্গজেব আবির্ভূত হন– তখনই শিবাজির উত্থান ঘটে। প্রত্যেক সালার মাসুদের জন্য রাজা সুহেলদেবের মতো সাহসী যোদ্ধারা আবির্ভূত হন। যার মাধ্যমে তাঁরা ভারতীয় ঐক্যের শক্তিকে সারা বিশ্বের কাছে প্রদর্শন করেন।’
ঔরঙ্গজেব তাঁর সেনাবাহিনীর কাফেলা নিয়ে বেনারসে এসেছিলেন– একথা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ কখনও বেনারস বা কাশীতে এসেছিলেন– এই ধরনের কোনও ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ নেই। তবুও মোদিজি ছত্রপতি শিবাজিকে বেনারসের মন্দির করিডর উদ্বোধনে টেনে আনলেন। এছাড়া মুসলিম দরবেশ-সন্ত ও বীর যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত সালার মাসুদ কাশী মন্দিরের সঙ্গে কোনওভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তিনি অবশ্য সোমনাথ– মিরাট– কনৌজ প্রভৃতি স্থানে অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল রাজায়-রাজায় যুদ্ধ। তার সঙ্গে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের কোনও সম্পর্ক ছিল না। এই দরবেশ-যোদ্ধার কবর রয়েছে উত্তরপ্রদেশে। এই মাজারে হিন্দু-মুসলিম সকলেই শ্রদ্ধা জানান। ইতিহাস খুঁজে মোদি বারাণসীর করিডর উদ্বোধনের সময় এইসব ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকেও বিভাজনের জন্য ব্যবহার করেছেন। এটা তাঁর পরম্পরাগত কৃতিত্ব।
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার আগেও সরকারি অর্থ ব্যয় করে মন্দির মেরামত ও পুর্ননির্মাণ হয়েছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর পরই ‘বড়ে সর্দার’ বল্লভভাই প্যাটেল সরকারি অর্থে গুজরাতে সোমনাথ মন্দির পুর্ননির্মাণ করেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল– সেক্যুলার রাষ্ট্রে এ দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তায় না। কিন্তু তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্টÉমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল প্রধানমন্ত্রীর কথা শোনেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল– মাহমুদ গজনি কয়েকবার সোমনাথ মন্দিরে হামলা চালিয়ে তাতে ভাঙচুর চালিয়েছেন এবং সেখানে রক্ষিত সোনা-রুপো ও অর্থ লুঠ করেছেন। কাজেই স্বাধীন ভারতে তার পুর্ননির্মাণ হিন্দু গৌরবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সেইসময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ। তিনিও হিন্দু গৌরবে বিশ্বাস করতেন। কাজেই বল্লভভাই প্যাটেলের সোমনাথ মন্দির পুর্নগঠনকে তিনি ভরপুর সমর্থন দেন। সেক্যুলার ভারতে সেই প্রথম সরকারি অর্থে কোনও ধর্মস্থান (এক্ষেত্রে মন্দির) নির্মিত হল।
তারপর মন্দির নির্মাণের সিলসিলা শুরু করেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি এবং ভাই অমিত শাহ। কাশী-বারাণসীতে মন্দিরের প্রসার– নবীকরণ এবং পরিপার্শ্বের ব্যাপক উন্নয়ন তারই একটি নজির মাত্র।
কিন্তু ভারতে বাদশাহদের তৈরি অনেক ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং ইবাদাতগাহ্ এখন ধ্বংসের মুখে। এই স্থাপত্যগুলি তার গঠনশৈলী– সৌন্দর্য এবং শিল্পকলার জন্য সারা বিশ্বে নাম করে নিয়েছে। এদেরই একটি হচ্ছে খোদ রাজধানী দিল্লিতে অবস্থিত জামা মসজিদ। মসজিদটি বিশ্বের অন্যতম বড় মসজিদ এবং শিল্প-সৌন্দর্যের অনুপম বৈচিত্র নিয়ে ভারতের এক ঐতিহাসিক হেরিটেজ হিসেবে গণ্য। মুঘল সম্রাট সাহাব-উদ-দিন মুহাম্মদ খুররম– যিনি শাহ জাহান নামে পরিচিত– তাঁরই অনন্য দু’টি কীর্তি হচ্ছে– আগ্রার তাজমহল এবং দিল্লির জামা মসজিদ। স্বাধীন ভারতে যখনই অন্যদেশের কোনও মুসলিম বাদশাহ বা প্রেসিডেন্ট ভারত ভ্রমণে আসেন– তারা জামা মসজিদেই জুম্মার নামায আদায় করতে চান। কিন্তু এই মসজিদটির মিনার– গম্বুজ– দেওয়াল ভেঙে পড়ছে। এই মসজিদটির দেখভালের দায়িত্ব ভারত সরকারের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হাতে। কিন্তু আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে বা পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই ঐতিহাসিক মসজিদটির দেখভাল ও প্রয়োজনীয় মেরামতিতে মোটেই আগ্রহী নয়। আর সেজন্যই বিশ্বখ্যাত এই মসজিদটি বিধ্বস্ত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ মাত্র দু-চার কোটি টাকা খরচ করলেই এই ঐতিহাসিক ও অনুপম স্থাপত্যের নিদর্শনকে আমরা রক্ষা করতে পারি। আর বেনারসের মতোই দিল্লির জামা মসজিদের ধর্মীয় গুরুত্বও কম নয়।
ভারত হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-শিখ-জৈন সকলেরই। সরকারি অর্থে কাশী-বেনারসের মন্দিরে যাওয়ার করিডর– বিস্তার ও সৌন্দর্যায়ন করে মোদি একটি মহান কাজ করেছেন। তবে অন্যান্য ধর্মের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থাপত্যগুলিকে এভাবে চোখের সামনে বিনষ্ট হতে দেওয়া কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অপমান এবং ভারতের সেক্যুলার চরিত্রের উপর তীব্র আঘাত।
মোদি বেনারস সফরে ঔরঙ্গজেবের কথাও উত্থাপন করেছেন। কিন্তু অনেকে অবাক হলেও ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে মোদির সামান্য হলেও কিছু মিল রয়েছে। যেমন ঔরঙ্গজেব ও মোদির দু’জনেরই স্বধর্মে প্রবল আস্থা রয়েছে। কিন্তু পার্থক্য হল– স্বধর্মে নিষ্ঠাবান ঔরঙ্গজেব কখনই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মনে আঘাত দেননি। বরং তিনি অসমের কামাখ্যা থেকে শুরু করে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বহু মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশাল জায়গীর ও জমি দান করেছেন। আর সবথেকে বড় কথা– ঔরঙ্গজেবের সময়ে কোথাও অমুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা হয়নি।
কারণ– ইনসাফ পসন্দ ঔরঙ্গজেব প্রকৃতই সব প্রজার প্রতি ন্যায় বিচারে বিশ্বাস করতেন। মোদি ক্ষমতায় থাকাকালীন গুজরাত– দিল্লি ও অন্যান্য জায়গায় রীতিমতো গণহত্যা ও বিশেষ এক ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে কখনও জেনোসাইড– কখনও বা ছোট-বড় হত্যালীলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নিষ্ঠা ও ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রায় প্রবাদপ্রতীম। কিন্তু তিনি এথেকে কোনও রাজনৈতিক ফায়দা তোলেননি। আর সেইসময় টেলিভিশন– ইন্টারনেট এগুলি ছিল না। কাজেই রাজনৈতিক ফায়দা বা হিন্দু বা মুসলিমদের খুশি করার মতো কোনও হাতিয়ার ঔরঙ্গজেবের ছিল না– হয়তো বা তার প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু মোদিজি তাঁর এইসব ধর্মীয় কাজের দ্বারা রাজনৈতিক ফায়দাও ওঠান বলে অনেকের অভিযোগ। মোদি ও ঔরঙ্গজেবের তুলনা করলে দেখা যায়– ঔরঙ্গজেব পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করতেন। যার মধ্যে ছিল পাকিস্তান– বাংলাদেশ– কাবুল– কান্দাহার প্রভৃতি দেশ। যেগুলি এখন মোদিজি শাসিত ভারতের অন্তর্ভুক্ত নয়।
কিন্তু শুধু মন্দির-মসজিদের সৌন্দর্যায়ন করলেই ঈশ্বর খুশি হন না। একইসঙ্গে ঈশ্বর চান মানুষ– জীবজন্তু ও পরিবেশের সেবা ও আর্তের প্রতি সক্রিয় সহানুভূতি। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন– ‘জীবে প্রেম করে যেইজন– সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’। তাই কাশী-বেনারসের কথা মনে পড়লে একদিকে যেমন আমার স্বদেশবাসীর ধর্মীয় অনুভূতির কথা মনে পড়ে— অন্যদিকে আমার মনে পড়ে বাঙালি বিধবাদের কথাও। বাংলায় একটা কথা হিন্দুদের মধ্যে চালু আছে ‘বার্ধক্যে বেনারসি’। অনেকে ধারণা করেন– কাশী-বারাণসীতে মৃত্যু হলে তা মোক্ষ ও স্বর্গ লাভের সহায়ক হয়। অন্য কেউ সেখানে বার্ধক্যে যান বা না যান– তার তথ্য পুরোপুরি আমার কাছে নেই। তবে আমাদের বাংলা থেকে যে প্রচুর অত্যাচারিত ও সহায়সম্বলহীনা হিন্দু বিধবারা বড় সংখ্যায় বেনারসে যান– তা কিন্তু অমোঘ সত্য। কিছু পরিবার থেকে আবার বাঙালি বিধবাদের বেনারসে ছেড়ে এসে দায়মুক্তি হাসিল করার চেষ্টাও করা হয় বলে ওয়াকিফাল মহল বলে থাকেন। অনেক সময় পুরোপুরি বৃদ্ধা না হলেও যুবতী বয়সের বিধবাদেরও বেনারসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরিবারের খুব কম লোকই পরে খোঁজ নেন– এই বিধবারা কি হালে জিন্দেগী যাপন করছেন। কিছু কিছু হিন্দু আশ্রম রয়েছে। যারা বিধবাদের ভজন ও ভাগবত গান গাওয়ার বিনিময়ে দু’বেলা সাধারণ আহারের ব্যবস্থা করে। কিন্তু ইদানিং এই ধরনের আশ্রমের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। মহিলা কমিশনের অনেকেই বলেছেন– এই বিধবাদের নানা ধরনের শোষণ ও নির্যাতন করা হয়। উপায়ন্তর না দেখে বিধবাদের মুখ বুজে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়।
যদি নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি পারেন– এই ধর্মপরায়ণ বিধবাদের খাওয়া-পরা-চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং তাদের হস্তশিল্প ও অন্য কাজে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলার প্রকল্প নিতেন– তাহলে কতই না ভালো হত। কাশী-বেনারসের মন্দিরের জন্য করিডর তৈরি ও সৌন্দর্যায়নের সঙ্গে মোদিজি এই কাজ করলে শিবঠাকুর অর্থাৎ কাশী বিশ্বনাথ প্রকৃত অর্থেই খুশি হতেন। মোদিজিকে দু’হাত ভরে আর্শীবাদ করতেন।