সুস্থ শিশুকে পৃথিবীতে আনার জন্য বদ্ধপরিকর চিকিৎসকরা। সেই শিশুকে ভালভাবে বড় করে তোলার জন্য মাকেও যে সুস্থ থাকতে হবে। তাই গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক অবস্থা ও শিশুর কোনও সমস্যা আছে কিনা জানার জন্য অনেক সময় কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার দরকার হয়। যদিও এই পরীক্ষার বিষয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ থাকে। বিশেষত যদি তা রেডিওলজির অর্থাৎ সিটি স্ক্যান– এক্সরে– বেরিয়াম পরীক্ষা– ফ্লুওরোস্কোপি হয়।
এই সন্দেহের নিরসন ঘটালেন বিশিষ্ট রেডিওলজিস্ট ডা. স্মরণ মজুমদার।
অনেকের ধারণা– গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন রশ্মি বিকিরণের ফলে শারীরিক ত্র&টিযুক্ত শিশু জন্মাতে পারে। যদিও আসল ঘটনা হল আমাদের অজান্তেই অনেক সময় কোনও না কোনও রশ্মি বিকিরিত হয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। তার প্রভাবও খুব কম নয়। কাজেই শুধুমাত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর ফলেই রশ্মি বিকিরণ দ্বারা ক্ষতি হয় এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। আর একটা ব্যাপার হল চিকিৎসাবিদ্যায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলে একটা কথা আছে। যখন দেখা যায় ক্ষতির তুলনায় লাভ অনেক বেশি তখনই কোনও পরীক্ষার নিদান দেন চিকিৎসকরা। তাই যে কোনও পরীক্ষা রেডিওলজি বিশেষজ্ঞ এবং স্ত্রীরোগ বা অন্য চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে করানো উচিত।
রশ্মি থেকে কী ক্ষতি হতে পারে?
রশ্মির সংস্পর্শে আসার জন্য দু’ভাবে ক্ষতি হতে পারে। অল্প করে বারবার কিংবা একবারে অনেকটা বিকিরণের প্রভাব আলাদা রকমের হতে পারে। তাই এ ধরনের পরীক্ষার আগে চিকিৎসকরা সাধারণত পরিবারের সদস্যদের থেকে কী কী পরীক্ষা আগে হয়েছে তা জেনে নেন।
গর্ভাবস্থার যে কোনও সময়ে ৫০ mGy (মিলিগ্রে)-র কম বিকিরণ সম্পূর্ণ নিরাপদ। তার বেশি হলে অর্থাৎ ৫০-১০০ mGy-এর মধ্যে হলে কিছু কিছু ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। আসলে mGy হল বিকিরণ মাপার একক। এর মাত্রা ১০০ ছাড়ালে বাচ্চার আইকিউ কম হওয়া থেকে বিকলাঙ্গ হওয়া– মানসিক সমস্যা পর্যন্ত হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় তিন থেকে সতেরো সপ্তাহ তো বটেই– আঠাশ সপ্তাহ পর্যন্ত ১০০ mGy এর বেশি বিকিরণের সংস্পর্শে যেন হবু মা না আসেন।
সিটি স্ক্যান করা কি যুক্তিযুক্ত?
সিটি স্ক্যানের গাইডলাইনে বলা হয়েছে নিতান্ত দরকার না হলে গর্ভাবস্থায় পরীক্ষাটি করা যাবে না। অন্য পরীক্ষা (যেমন ইউএসজি বা এমআরআই) করে যদি প্রয়োজন মিটে যায় তাহলে তাই করতে হবে। একান্তই করতে হলে বিকিরণের পরিমাণ যতটা সম্ভব কম করা যায়– মেশিনে নানারকম পরিবর্তন করে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে শিশুর শরীরে যেন কোনওভাবেই বেশি বিকিরণ না যায়।
ফ্লুওরোস্কোপি ও এক্সরে কি নিরাপদ?
দুই পদ্ধতিতেই বিকিরণ ব্যবহার করা হয়। সেই বিকিরণের পরিমাণ কতটা হতে পারে– তার ব্যবহার রোগীর ক্ষতির চেয়ে উপকার বেশি করবে কিনা তা ঠিক করেই কারও কী করা দরকার চিকিৎসকরা সেই সিদ্ধান্ত নেন। তবে গর্ভাবস্থার তিন থেকে সতেরো সপ্তাহে খুব জরুরি না হলে বারবার এক্সরে না করাই ভালো। কোনও রকম ভাঙাচোরায় বা টিউমার কিংবা জরুরি অপারেশনের দরকার হলে অল্প বিকিরণ ব্যবহার করে এক্সরে করা দরকার। আর বুকের কিংবা কোমরের এক্সরে সাধারণত কোনও ক্ষতি করে না।
সেক্ষেত্রে আল্ট্রাসাউন্ড বা ইউএসজি তো করানো যেতে পারে কি?
রেডিওলজিস্টের তত্ত্বাবধানে এই পরীক্ষা করা হলেও এক্ষেত্রে বিকিরণের ব্যবহার করা হয় না বলে তুলনায় নিরাপদ। প্রেগন্যান্সির যে কোনও সময়ে মা ও শিশুর শারীরিক অবস্থা জানার জন্য ইউএসজি করা যেতেই পারে। তবে তা স্বীকৃত কোনও বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্টকে দিয়েই করানো উচিত। না হলে বিনা প্রয়োজনে বারবার করাতে হতে পারে কিংবা বিকিরণ ব্যবহার করা হয় তেমন কিছুও করাতে হতে পারে।
গর্ভাবস্থার প্রথম আট সপ্তাহ পর্যন্ত খুব বেশি সময় ধরে ইউএসজি করা উচিত নয়। কারণ শব্দ শক্তি এক্ষেত্রে তাপ শক্তিতে পরিণত হয় এবং গর্ভের সন্তানের ক্ষতি করতে পারে। এছাড়া কালার ডপলার এবং পাওয়ার ডপলার বলে দু’টি প্রযুক্তি ইউএসজি-তে ব্যবহার করা হয়। দরকার না হলে এসব না করাই ভাল। কারণ ওতে অনেক বেশি শব্দ শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
গর্ভাবস্থায় সাধারণত তিনবার ইউএসজি করার নিয়ম আছে। কিন্তু দরকারে আরও বেশিবার ইউএসজি করাতে পারেন। যদিও বারবার ইউএসজি না করাই ভাল। ইউএসজির সময় ফোকাসড স্ক্যানও একমাত্র বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্টই প্রয়োজন বুঝে অল্প সময়ে তা করতে পারেন।
অ্যানোম্যালি স্ক্যান যা সাধারণত গর্ভাবস্থায় তৃতীয় ও পঞ্চম মাসে সন্তানের শরীরের সব কি খুঁটিয়ে দেখার জন্য করা হয়। তাও বিশেষজ্ঞকে দিয়েই করানো উচিত।
মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় যদি দেখা যায় সন্তানের কোনওরকম সমস্যা আছে এবং ইউএসজি-তে পুরোটা বোঝা যাচ্ছে না– সেক্ষেত্রে এমআরআই করা যাবে। সিটি স্ক্যানও করা যেতে পারে, তবে লাভ-ক্ষতির হিসেব মিলিয়ে কম বিকিরণ ব্যবহার করে তা করতে হবে।
যোগাযোগ ৮৫৮২৯ ৪৮০১০
সাক্ষাৎকার শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়