আবদুল ওদুদ
চিকিৎসকের কাজ রোগীকে সুস্থ করে তোলা। বিশ্বের যত মহান পেশা রয়েছে তার মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। তবে আজকের দিনে বড় হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের যে ভাবমূর্তি জনমনে ঠাঁই পেয়েছে তা ইতিবাচক নয়। বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের নেহাৎই অন্য পেশার মানুষজনের মতোই সাধারণ মনে হয়। সেখানেই ব্যতিক্রমী এই চিকিৎসক।
নদিয়া জেলার বেথুয়াডহরি এলাকার চন্দনপুরের গ্রামে বড় হওয়া চিকিৎসক ডা. নুরুল ইসলাম শিশুদের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। কলকাতায় পড়াশোনার পর চাকরি সূত্রে সোজা দিল্লিতে পাড়ি জমান। কিন্তু শহর কলকাতা কিংবা বেথুরাডহরির সেই গ্রামের কথা আজও ভুলতে পাবেননি। বাংলার ছোট ছোট শিশুদের টানে ২০১৪ সালে ফের রাজ্যেই ফিরে আসেন। কিন্তু কলকাতায় নয় দুর্গাপুরে।
কলকাতার শিশুমঙ্গল হাসপাতাল থেকে এমডি করার সময সিদ্ধান্ত নেন এ রাজ্যের শিশুদের জন্য মাসে একদিন সময় বের করবেন। এরপর স্থির করেন প্রতিমাসের তৃতীয় রবিবার কলকাতায় বিনামূল্যে শিশুদের চিকিৎসা পরিষেবা দেবেন। আর এই ভাবনা থেকেই ২০১৩ সালের আগস্ট মাস থেকে এই কাজ শুরু করেন। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত কলকাতার শরৎ বোস রোডে অবস্থিত বেলুড় মঠ রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা পরিচালিত শিশুমঙ্গল হাসপাতালে শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে আসছেন। দিল্লিতে থাকাকালীন নিজের খরচে বিমানভাড়া দিয়ে নিয়মিত আসতেন। এখনও দুর্গাপুর থেকে এলেও কোনও খরচ নেন না। তার একজন সহযোগীকে নিয়ে আসেন। তাঁর খরচ ডাক্তারবাবু নিজেই বহন করেন।
শিশুদের হার্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নুরুল ইসলাম জানান, কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৯৯-২০০৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করে এমবিবিএস পাশ করেন। ২০০৫ সালে তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলার অফ মেডিসিন এবং সার্জারি ডিগ্রি অর্জন করেন। ওই সময় মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্নশিপ করেন।
নুরুল ইসলাম জানান, ২০০৭-১০ সাল পর্যন্ত এমডি করার সময় একটি বিষয় তাঁর নজরে আসে। প্রচুর দুস্থ পরিবার হার্টের চিকিৎসার জন্য শিশুদের নিয়ে আসেন হাসপাতালে।
তখনই সিদ্ধান্ত নেন, মাসে অন্তত একটি দিন এই দুস্থ পরিবারের শিশুদের জন্য সময় দেবেন। এর পর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য দিল্লি, লন্ডন ছুটতে হয় তাঁকে। দিল্লির ডিএনবি বোর্ড থেকে স্পেশাল প্রশিক্ষণ নেন ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এর পরই দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে চাকরি শুরু করেন। বিনামূল্যে শিশুদের হার্টের চিকিৎসা শুরু হয় ২০১৩ আগস্ট থেকেই।
প্রতিমাসে ৪০ থেকে ৫০ জন শিশুর হৃদরোগের চিকিৎসা করেন। নিয়ম করে একজন সহযোগীকে নিয়ে এসে শিশু মঙ্গল হাসপাতালে পাশাপাশি তিনি নানান সামাজিক কাজ করেন। শিশুদের চিকিৎসার পর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকলে শিশুমঙ্গল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাত্র ৩০০ টাকায় করে দেয়। বাইরে যেখানে ৩০০০ টাকা খরচ হয়।
ডা. নুরুল ইসলাম আইডিবি স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বড় হওয়া ডাক্তার নুরুল এখনও গ্রামকে ভুলে যাননি। সময় পেলেই ছুটে যান বেথুয়াডহরির গ্রামের বাড়িতে। স্থানীয় শিশু থেকে বড় অনেকেরই বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন। মালদা– শিলিগুড়ি– মুর্শিদাবাদেও শিশুদের হার্টের চিকিৎসা করছেন। সেখানেও অনেককেই বিনামুল্যে চিকিৎসা পরিষেবা পান।
বর্তমানে দুর্গাপুর সিটি সেন্টারে হেলথ ওয়ার্ল্ড হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসক নুরুল ইসলাম। ২০১৬ সালে লন্ডনের ইভিলিনা চিলড্রেন’স হাসপাতাল থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। আল আমিন মিশনের খলতপুর শাখায় ষষ্ঠশ্রেণীতে পাঠরত এক এয়াতিম মেয়ের সারা বছরের খরচ বহন করেন মানব দরদী এই চিকিৎসক।
কলকাতার ‘নব দিগন্ত’-এ আরও ৫ জনের পুরো খরচ বহন করেন তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ডা.বেনাজির সুলতানা। স্ত্রীও সমাজসেবার কাজে সমানভাবে সহযোগী।