জঙ্গি সন্দেহে ডোমকল থেকে ছ’জন ও কেরল থেকে আরও তিন জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় সাড়ে তেরো মাস। গ্রেফতার হওয়া পরিবারের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ‘পুবের কলম’ প্রতিনিধি জিশান আলি মিঞা। আজ শেষ কিস্তি।
প্রায় সাড়ে তেরো মাস আগে জঙ্গিযোগে নাম জড়িয়েছিল মুর্শিদাবাদের। ধৃত ন’জনের মধ্যে অন্যতম ডোমকলের নওদাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আল মামুন কামাল। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে তিনি কেরলের এরনাকুলামে এলাকার আরও বেশ কিছু শ্রমিকের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গতবছর লকডাউনে কাজ হারিয়ে সেখানে বসেছিলেন। লকডাউন কিছুটা শিথিল হতেই বাড়ি ফেরেন তিনি। তার দিন কয়েক পরেই জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র হাতে ধরা পড়েন তিনি। জানা গিয়েছে– এলাকায় একটি শিশু মাদ্রাসা তৈরির পরিকল্পনা ছিল তার। বাড়ি ফিরলে এলাকার একটি ওয়াক্তিয়া মসজিদে নামায পড়ার পর মুসল্লিদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে পাকা মসজিদ তৈরি ও ওই মাদ্রাসার তৈরির বিষয়ে কথা বলতেন তিনি। ওই মসজিদের এলাকার বেশ কিছু শিশু-কিশোর আরবি পড়তে আসত। এনআই-র দাবি ওই মাদ্রাসায় চলত জঙ্গি কার্যকলাপ। যদিও সেই দাবিকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করছেন গ্রামের বাসিন্দারাই। শিশু মাদ্রাসা তৈরির জন্য চাঁদা সংগ্রহের জন্য ছাপানো কুপন পেয়ে তদন্তকারীরা দাবি ছিল তার এলাকায় একটি মাদ্রাসায় চলত জঙ্গি কার্যকলাপ এবং মাদ্রাসার নামে তোলা হত লক্ষ লক্ষ টাকা। কেরল থেকেও তাঁর অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের টাকা আসত বলে দাবি করেছিলেন তদন্তকারীরা। বর্তমানে তার ঠাঁই হয়েছে দিল্লির তিহার জেলে।
গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি মাটির দেওয়াল– টালির ছাউনিদেওয়া এবং বাঁশের রেলিং দিয়ে ঘেরা ওই ঘরটি আদতে একটি ওয়াক্তিয়া মসজিদ। যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন এলাকার মুসল্লিরা। ওই পাড়ার প্রায় চল্লিশটি পরিবারের লোকজন আলোচনা করে ঠিক করেন ওই এলাকায় একটি পাকা মসজিদ করা প্রয়োজন। স্থানীয়দের দানে সেই কাজ শুরু হলেও লকডাউনের কারণে তা থমকে পড়ে। আল মামুন কামাল ওই মাদ্রাসার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। গ্রামেরই একজন ওই ওয়াক্তিয়া মসজিদে এলাকার ছেলেমেয়েদের আরবি পড়াতেন।
প্রথাগত লেখাপড়ার পাশাপাশি আরবি শিক্ষার জন্যই গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ এই উদ্যোগ নিয়েছেন বলে দাবি স্থানীয়দের একাংশের। গ্রামের এক বাসিন্দা বলছেন এলাকার অধিকাংশ যুবক কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করে। জানা গিয়েছে কেরল থেকে আল মামুনের অ্যাকাউন্টে টাকা আসলেও তা ওই মাদ্রাসা তৈরির কাজেই লাগানো হত। আল মামুন গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই থমকে মাদ্রাসা মসজিদ তৈরির কাজ। বাকি সন্দেহভাজনদের সঙ্গে তিহার জেলে বন্দি আল মামুন।
এ দিকে তার স্ত্রী– সন্তান– বৃদ্ধ বাবা দিন কাটাচ্ছেন কষ্টেসৃষ্টে। অর্থের অভাবে উকিল দিতে পারেননি তাঁরা। মানবাধিকার সংগঠনের দেওয়া উকিলের উপরেই ভরসা করে ছেলের মুক্তির আশায় পরিবারের লোকেরা। জঙ্গি কার্যকলাপে ছেলে জড়িত এ কথা কোনও মতেই মানতে পারছেন না তাঁর আব্বা ভলান্টিয়ার সেনা ফরজ আলি মণ্ডল। তিনি বলেন– আমি ১৯৬২ সালে লাদাখ সীমান্তে চিনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি– আমার রক্ত ছেলের শরীরে বইছে। ও কখনোই জঙ্গি কার্যকলাপে বা দেশদ্রোহী হতে পারে না। তাঁর দাবি ছেলেকে শুধু শুধু জঙ্গি তকমা দেওয়া হচ্ছে। সঠিক তদন্ত করে ছেলের মুক্তি চাইছেন আল মামুনের আব্বা।
ঘটনার সাড়ে তেরো মাস পরেও ওয়াক্তিয়া মসজিদ বা মাদ্রাসায় জঙ্গি কার্যকলাপ চলত সেকথা মানতে নারাজ গ্রামের বাসিন্দা। একই সময়ে জলঙ্গির মধুবোনা গ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয় মইনুল মণ্ডলকে। তিনিও কেরলে একটি পাউরুটির কারখানায় কাজ করতেন। তদন্তকারীদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার দিন কয়েক আগেই তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে দীর্ঘদিন জেল বন্দি থাকায় উৎকণ্ঠায় রয়েছেন পরিবারের লোকেরাও। সীমান্তের বাসিন্দারাও চাইছেন নিরপেক্ষ তদন্ত করুক তদন্তকারীরা।