হিলাল আহমেদ
তাহলে নামায নিয়ে সমস্যা কোথায়?
নামাযকেন্দ্রিক মুসলিম ধার্মিকতার প্রকাশ জনসমক্ষে দেখতে পাওয়া যাবে শহরের আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদের সবুজ মিনারে, ব্যস্ত রাস্তায় মুসলিমদের জমায়েতে এবং আযানের সুললিত উচ্চস্বরে। এর মধ্যে দেশে বহু মসজিদকে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে বা নতুন করে কিছু মসজিদ গড়ে উঠেছে। রাম মন্দির পরবর্তী প্রেক্ষিতে এই নামায হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদদের কাছে তিনটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
প্রথমত– হিন্দুত্ববাদীদের সেই পুরনো দাবি যে– মুসলিমরা কেবলমাত্র আল্লাহর উপাসনা করে, দেশের পূজা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাদের আলাদা করে দেশভক্তির প্রমাণ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত– নামায পাঠ করাকে একটি নতুন ধারণায় পরিচিত করানোর প্রচেষ্টা হচ্ছে। ধারণাটি হল, হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে ও বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুসলিমদের এই নামায পাঠ। জামাতবদ্ধভাবে রাস্তায় নামায পড়াকে যাতে এভাবেই দেখা হয় তার জন্য চেষ্টা চলছে। যেন প্রকাশ্যে নামায পড়া অনুমোদনযোগ্যই নয়।
ঠিক এই যুক্তিই উত্তরাখণ্ডে বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও বজরং দল দিয়েছে। তারা উত্তরাখণ্ডের ক্যাবিনেট মন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়ে ‘তদন্ত’ দাবি করে। অভিযোগ– বদ্রীনাথধামে কিছু মুসলিম শ্রমিক ঈদ-উল-আযহার নামায পাঠ করেছিল। এই মামলায়, উঠে আসে সেই প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদী শুচিতার যুক্তি। হিন্দুদের পবিত্র এলাকা ও শহরেও নামায পাঠ করা চলবে না। তাতে এলাকার এবং সেখানের মন্দিরের শুচিতা নষ্ট হয়। তৃতীয় সম্ভাবনাটি পুরোপুরিই শ্রেণিসংক্রান্ত। রাস্তায় নামায পড়াকে একটি গুরুতর যান চলাচলের সমস্যা হিসাবে দেখানো হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীরা বলছে– মুসলমানরা কেন আপাত নির্জন খোলা জায়গায় বা পার্কে কিংবা রাস্তার একপাশে নামায আদায় করার সুযোগ পাবে? এতে যানজট হয় এবং অনেক সময় ভোগান্তিও হয়। বর্তমান প্রেক্ষিতে হিন্দুত্ববাদীরা অনায়াসে এইসব দাবি তুলে শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে প্রভাবিত করতে পারে।
ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ– ক্ষমতাধর অভিজাত শ্রেণি
ভারতীয় এলিটদের (ক্ষমতাধর অভিজাত শ্রেণি) তাদের অনমনীয় কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতার পিছনে রয়েছে তাদের গরিব-বিরোধী ও নিম্ন বর্ণ-বিরোধী ছক বাঁধা স্ট্রিরিওটাইপ চিন্তাধারা। যদি কেউ বিশ্বাস করেন যে, সংরক্ষণের ফলে মেধার অবমূল্যায়ন ঘটছে, ভারতে সামরিক শাসন জারি করা উচিত বা দেশের সামাজিক সমস্যার একমাত্র কারণ হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি, তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবেই হিন্দুত্ববাদী যুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে চলেছেন। তিনটি নতুন দাবি কিংবা প্রচারণা হচ্ছে, আল্লাহর একত্ববাদ দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী। নামায হচ্ছে একটি অপবিত্র হিন্দুবিদ্বেষী কাজ এবং নামায নাগরিক এলাকায় জায়গার সংকট তৈরি করছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এই কথাগুলি মুসলিমদের অন্তরাত্মা ও চেতনাকে আঘাত দেয়। এর উদ্দেশ্য হল– মুসলিমদের প্ররোচনা প্রদান– যাতে তারা সংঘবদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে হিন্দুদের বঞ্চনাবোধকে আইনগত ভিত্তি দেয়।
আরও পড়ুনঃ নামায হিন্দু-বিরোধী নয়, দেশ-বিরোধীও নয়, মুসলিমদের ‘নয়া অস্পৃশ্য’ বানাবার অপচেষ্টা
কেউ জানে না, মুসলিম সম্প্রদায় নামাযের বিরুদ্ধে এই নয়া অপপ্রচারের প্রতিক্রিয়ায় কী করবে। আমি এই আইনি ও সেকুল্যার যুক্তিতে ব্যক্তিগতভাবে আশ্রয় নিতে চাই না। অর্থাৎ আমি বলব না যে, নামায পড়া একজন নাগরিক হিসেবে আমার মৌলিক অধিকার। পরিবর্তে আমি আমার সেই দৃঢ় বিশ্বাস, যার প্রতি আমার আস্থা রয়েছে তাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাইব। আর সেটা হচ্ছে ‘হিন্দু ইথোস’ বা হিন্দু মূল্যবোধ ও তত্ত্বকে পুনরায় ব্যাপ্ত করব। আমি আত্মবিশ্বাসী ও নিশ্চিত যে– আমার হিন্দু বন্ধুরা নিশ্চিতভাবে ইসলামের প্রতি তাদের ধারণাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন এবং ইসলাম যে একটি ভারতীয় ধর্ম, তা জোরের সঙ্গে তুলে ধরবেন।