পুবের কলম প্রতিবেদক: জাতীয় মান হারাচ্ছে কলকাতার বনহুগলিতে অবস্থিত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য হাসপাতাল ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অর্থোপেডিক্যালি হ্যান্ডিক্যাপড’ বা এনআইওএইচ। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের জন্য হাসপাতাল ও ট্রেনিং সেন্টার-এর সদর দফতর চলে যাবে ওড়িশার কটকে। কেন্দ্রীয় সরকার এমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। শুরু হয়েছে আন্দোলন।
প্রসঙ্গত– উত্তর-পূর্ব ভারতের একমাত্র এই হাসপাতাল বিগত ১৯৭৮ সাল থেকে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে আসছে। সেই হাসপাতালকে আরও উন্নত না করে বরং জাতীয় মান কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ওড়িশার রাজধানী কটক থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরের এক প্রতিবন্ধী হাসপাতালের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। আর কলকাতায় অবস্থিত হাসপাতাল বা ইনস্টিটিউটকে তার শাখাতে পরিণত করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য– কলকাতা– কটক এবং দিল্লি মিলিয়ে সারা দেশে মোট তিনটি এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে পশ্চিমবঙ্গ সহ পাশ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ– নেপাল– ভুটান থেকেও অনেক রোগী চিকিৎসা পরিষেবার জন্য আসে।
নানান কারণে এনআইওএইচ বা বর্তমান ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ লোকামোটর ডিজ্যাবিলিটিস্’-এর নাম রয়েছে। এখানে অস্থি সংক্রান্ত উন্নতমানের চিকিৎসা করা হয়। অপারেশনের পর কারও সমস্যা দেখা দিলে বা কৃত্রিম পাত-পা লাগানোর ব্যবস্থাও করা হয়। বিকলাঙ্গদের চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে বড় ভূমিকা পালন করেছে এই প্রতিষ্ঠান। রাজ্য সরকার জমি দিয়েছে– হাজার হাজার মানুষ এখানে চিকিৎসা করে উপকৃত হয়েছে তার পরও কেন বন্ধ করে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি বা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। যা নিয়ে অখুশি ডাক্তার– রাজ্যের সাধারণ মানুষ ও কর্মচারীরাও।
প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও। তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন– কেন্দ্রীয় সরকার কোনও সময়েই কারও ভালো করার চিন্তা করে না। কেন সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা কেন্দ্র বলতে পারবে। আসলে চিকিৎসার ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারেরও একটা দায়িত্ব রয়েছে– কিন্তু কেন্দ্র তা করছে না। এর মাধ্যমে বাংলা ও সংলগ্ন রাজ্যের প্রতিবন্ধীদের সমস্যা দেখা দেবে। এটা বঞ্চনা ও রাজনীতিকরণ।
কেন্দ্র সরকারের কেন এই উদ্যোগ? এই প্রসঙ্গে এনআইওএইচ বাঁচাও কমিটির আহ্বায়ক ডা. অমিত ধবল জানান– কেন্দ্র সরকার খরচ কমানোর জন্য এই প্রয়াস নিয়েছে। এই নিয়ে ২০১৪ সালে কেন্দ্র সরকার আইনও পাশ করেছিল। তিনি আরও বলেন– এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান– যেখানে রাজ্য-সহ প্রতিবেশি রাজ্য– দেশ থেকে বহু রোগী পরিষেবা নিতে আসেন। এখানে এসে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা পান রোগীরা। ইদানিং দেখা যাচ্ছে– সমস্ত বিভাগে ‘ফ্যাসিলিটি’ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার ও কর্মচারি নিয়োগ না করার ফলে ধীরে ধীরে পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির পরিবর্তে অস্থায়ী কমিটি গঠন করা হচ্ছে। ওড়িশার কটকে এই হাসপাতালের সমস্ত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে যাওয়ার ফলে হাসপাতালের নিজস্বতা হারাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই হাসপাতালের দায়িত্ব ওড়িশার কটক সংলগ্ন এলাকায় চলে যাওয়া প্রসঙ্গে বনহুগলি হাসপাতালের ডিরেক্টর ডা. মুহাম্মদ ইকবাল বলেন– এটা কেন্দ্র সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে– হাসপাতালের পরিষেবা অব্যাহত থাকছে। এখানে ম্যানেজমেন্ট থাকবে।
ডা. ইকবাল আরও বলেন– এই হাসপাতাল চল্লিশ বছর ধরে চলছে। মানুষকে পরিষেবা দিয়ে আসছে। সেইগুলি মানুষের সামনে আসা উচিত বলে তিনি জানান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে– শল্যচিকিৎসক নেই। কেন্দ্রকে জানিয়েছি। না দিলে আমাদের কিছু করার নেই।
এদিকে হাসপাতাল বাঁচাও কমিটির অভিযোগ– ধীরে ধীরে এই হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা তলানিতে যাচ্ছে। হাল ফেরানোর উদ্যোগ না নিয়ে উলটে খরচ কমানোর নামে পরিষেবাকে সীমিত করে দেওয়ার পথে হাঁটা হচ্ছে। এই হাসপাতালের বর্তমান হালহকিকত সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বাঁচাও কমিটির তরফে অভিযোগ করা হয়– হাঁটু– নিতম্ব– কোমর ও ঘাড়ের হাড় কিংবা মেরুদণ্ড প্রতিস্থাপনের মতো যাবতীয় বড় অস্ত্রোপচার বন্ধ। একজনও সার্জেন নেই। অভিযোগ– শুধু প্লাস্টারের মতো সামান্য চিকিৎসা হচ্ছে। জটিল সমস্যা এলে আউটডোর থেকেই রোগীদের বিদায় করা হচ্ছে। ফলে ভাঙা হাত বা পা ঠিক করার যে অস্ত্রোপচার অল্প খরচে করা যেত– সেটা বেসরকারি জায়গায় করতে হাজার হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে রোগীদের।
জানা গিয়েছে– বিকলাঙ্গদের জন্য কৃত্রিম হাত– পা– ক্র্যাচ– ক্যালিপার– হুইলচেয়ার তৈরি কাজও তলানিতে ঠেকেছে। প্রতিবন্ধীদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মাত্রা মাপার কাজও বন্ধ। ফিজিওথেরাপি বিভাগে অধিকাংশ পদ খালি থাকায় ওই বিভাগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোনও রেডিওলজিস্ট না থাকার ফলে অধিকাংশ রোগীর এক্স-রে হচ্ছে না। বড় অস্ত্রপচারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কৃত্রিম হাত-পা ও ক্যালিপার তৈরির সংখ্যা কমেছে। এই সমস্ত অভিযোগ কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী প্রতিমা ভৌমিককে লিখিতভাবে জানানো জানিয়েছে হাসপাতাল বাঁচাও কমিটি।
অস্থির আঘাতজনিত চিকিৎসার জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র স্তরে এই হাসপাতালের সুনাম রয়েছে। হাসপাতালে এসে হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রোগী-পরিজনদের। এই হেনস্থার অভিযোগ দায়ের হচ্ছে সমাজকল্যাণ দফতর– রাজ্য প্রতিবন্ধী কমিশনার ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।
হাসপাতালের চিকিৎসকের বক্তব্য– ১০-১৫ বছর আগেও অস্থির চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারে এই হাসপাতাল ছিল রাজ্যে এক নম্বর। গত এক বছর ধরে বোন-গ্রাফটিং– হিপ অ্যান্ড নি রিপ্লেসমেন্ট– অ্যাম্পুটেশনের মতো অস্ত্রোপচারও হচ্ছে না। আউটডোরে ইঞ্জেকশন দিয়ে হাঁটু থেকে জল বার করা বা বেঁকে যাওয়া পায়ের পাতা সোজা করার মতো সামান্য বিষয়গুলিকে অস্ত্রোপচার বলে তালিকাভুক্ত করে কেন্দ্রের চোখে ধুলো দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।
এনআইওএইচ কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের আওতাধীন। ওই মন্ত্রকের প্রতিবন্ধী ক্ষমতায়ন বিভাগের এক কর্তার কথায়– ‘ওই হাসপাতালের সমস্যা জানি। যেহেতু সার্জেনের ব্যবস্থা করতে হবে স্বাস্থ্যমন্ত্রক থেকে– তাই স্বাস্থ্য ও সামাজিক ন্যায় এই দুই মন্ত্রকের সমন্বয় সাধনে একটু সময় লাগছে বলে মত দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।