সফিকুল ইসলাম (দুলাল), বর্ধমান: বর্ধমানের মহারাজ বিজয়চাঁদের ঘড়ি প্রেমের কাহিনী কারুর অজানা নয়। রাজবাড়ির আনাচে-কানাচে তিনি শখ করে অসংখ্য দেশী-বিদেশী ঘড়ি লাগিয়েছিলেন। এর মধ্যে অঞ্জুমান কাছারির ছাদে যে চতুর্মুখ ঘড়িটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটি ছিল সবথেকে জনপ্রিয়। এই বেনসন টাওয়ার ক্লকের সুমিষ্ট ঘন্টাধ্বনিতে একসময় বর্ধমানবাসীদের ঘুম ভাঙত। ঘুম ভেঙে ওঠা থেকে শুরু করে কাজে যাওয়া, বিশ্রাম নেওয়া ও রাতে ঘুমাতে যাওয়া সবই নির্ধারিত হতো এই ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে। ঘড়িটি এমন জ্যামিতিক কোনে লাগানো হয়েছিল যে কার্জেনগেটের সামনে থেকেও ঘড়ি দেখতে কারুর অসুবিধা হত না।
এহেন গুরুত্বপূর্ণ ঘড়িটি হঠাৎ ১৯৩২ সালে অচল হয়ে গেল।ঘড়ির সঙ্গে বর্ধমানবাসীদের সময়জ্ঞানও গেল অচল হয়ে। মহারাজও খুব অস্থির হয়ে পড়লেন।ঘড়িটির নীরবতা মহারাজকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। ঘড়িটি মেরামত করার জন্য মহারাজ চিঠি লিখলেন সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত ঘড়ি কোম্পানি “ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ” কোম্পানির কলকাতার অফিসে।কোম্পানির মেকানিক হিসেবে রাজবাড়িতে ঘড়ি সারাতে এলেন তাহের সাহেব। তাহের সাহেবের পুরো নাম সৈয়দ আবু তাহের।তাঁর জন্ম দক্ষিন দামোদরের বামুনপুকুর গ্রামে।হুগলির চাঁপাডাঙার বিখ্যাত ঘড়ি মেরামতকারী গোপালচন্দ্র কর্মকারের কাছে তাহের সাহেবের ঘড়ি মেরামতি শিক্ষার হাতেখড়ি। গোপালচন্দ্র কর্মকার মশাই-ই তাহের সাহেবকে “ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ” কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এরপর ঘড়ি মেরামতকারী হিসেবে তাহের সাহেবের খুব নামডাক হয় সারা বাংলায়। তাহের সাহেবের হাতের জাদুকাঠিতে বেনসন টাওয়ার ক্লকের কাঁটা আবার ফিরে পেল তার পুরোনো স্পন্দন।টিকটিক শব্দে পেল্লাই কাঁটা দৌড়াতে লাগলো, সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে পড়া বর্ধমানের জনজীবনও।
এদিকে রাজামশাই বেজায় খুশি।খুশিতে আত্মহারা হয়ে রাজামশাই তাহের সাহেবকে প্রচুর টাকাপয়সা তো দিলেনই, সঙ্গে তাঁকে বর্ধমানে পাকাপাকি থেকে যেতে বললেন রাজবাড়ির ঘড়ি মিস্ত্রী হিসেবে।বর্ধমানে থাকার জমিজায়গা সহ মাসিক ৩০ টাকার মাইনে দেবার প্রস্তাব দিলেন মহারাজা।তাহের সাহেব রাজি হলেন না, কারণ তিনি “ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ” কোম্পানিতেও একই পরিমান টাকা বেতন পেতেন।তখন রাজামশাই তাহের সাহেবকে “চিফ কোর্ট ক্লক রিপেয়ারার” পদে নিযুক্ত করলেন।ঠিক হল ৩০ টাকা বেতন তো পাবেনই সঙ্গে রাজবাড়ির সমস্ত ঘড়ি তাহের সাহেবকে মেরামত করতে হবে।তার জন্য পাবেন আলাদা পারিশ্রমিক। শোনা যায় সেইসময় তাহের সাহেব রাজবাড়ির সব ঘড়ি মেরামত করে উপার্জন করতেন মাসে দশ থেকে বারো হাজার টাকা।
আজ বর্ধমানের বি সি রোড চত্বরে যত পুরনো বনেদী ঘড়ির দোকান আছে, তাদের আদি পুরুষরা ঘড়ি মেরামত করা শিখেছেন এই তাহের সাহেবের কাছেই।তিনি ছিলেন তখনকার দিনের ভিআইপি ঘড়ি মেকানিক।তাহের সাহেবের পরিবার সুত্রে শোনা একটি গল্প এখানে না বললেই নয়। এক রাতে তাহের সাহেব বিসি রোডের দোকান বন্ধ করছেন, এমন সময় হাজির দুই রাজ পেয়াদা।রাজামশাই তলব করেছেন এখুনি যেতে হবে রাজবাড়ি।খুব টেনশন নিয়ে তাহের সাহেব রাজবাড়ি গিয়ে দেখেন মহারাজ বিজয়চাঁদ হাতে একটি ঘড়ি নিয়ে উদ্বিগ্ন চিত্তে পায়চারী করছেন রাজবাড়ির লম্বা বারান্দায়। তাহের সাহেবকে দেখেই বললেন, “এই যে তাহের! দেখতো ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে।ঘড়িটি চলার সময় খুব সুন্দর একটা শব্দ হয়। এই শব্দ না শুনলে তো রাতে আমার ঘুমই আসবে না। ঘড়িটা এখুনি আমায় সরিয়ে দাও”। তাহের সাহেব আর কি করেন, রাজআদেশ বলে কথা। ঘড়িটি নিয়ে আবার দোকান খুললেন।ঘড়িটি খুলে দেখলেন একটা যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। লেদ মেশিন দিয়ে সেই যন্ত্রাংশ বানিয়ে ঘড়ি ঠিক করে ঘন্টা দুয়েক পরে গেলেন রাজবাড়ি।গিয়ে দেখেন রাজামশাই তখনও জেগে ঘড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। ঘড়ি পেয়েই রাজামশাই এর সেকি আনন্দ।শিশুর মত ঘড়িটা কানে চেপে ধরে ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ শুনতে থাকলেন।গাউনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একমুঠো টাকা বার করে গুঁজে দিলেন তাহের সাহেবের হাতে।
তাহের সাহেব বাড়ি ফিরে টাকাগুলো বার করে গুনতে গিয়ে বিষম যাওয়ার মতো হলেন। দেখলেন হাতে সাতটি একশ টাকার কড়কড়ে নোট। সেই সময় সোনার ভরি ছিল ১৫ টাকা, আর বর্ধমানে এক বিঘে জমির দাম ছিল ১৭ টাকা।রাজামশাই রাতে বন্ধ ঘড়ির আওয়াজ শোনার আনন্দে তাঁকে দিয়েছেন ৭০০ টাকা। এমনই ছিলেন রাজা বিজয়চাঁদ। বর্ধমানের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা। যাইহোক তাহের সাহেবের রাজবাড়ির ঘড়িওলার কাজ চলতে থাকলো, সঙ্গে দোকানও চালাতো লাগল রমরমিয়ে। বিজয়চাঁদ মারা গেলেন।রাজা হলেন উদয় চাঁদ। মহারাজা উদয়চাঁদের সঙ্গে তাহের সাহেবের সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো। এরপর ১৯৫৪ সালে জমিদারী প্রথার অবসান ঘটে। মহারাজ উদয়চাঁদ বর্ধমানে জায়গা জমি সম্পত্তি কিছু বিক্রি করলেন, আর বেশিরভাগ দান-খয়রাত করে চলে গেলেন কলকাতার রাজ প্রাসাদ বিজয় মঞ্জিলে পাকাপাকি ভাবে। যাবার আগে মহারাজ সমস্ত রাজকর্মচারীদের উপহার দিচ্ছেন রাজবাড়িতে তাদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য। জায়গা-জমি , আসবাব -পত্র , যে যা চেয়েছে মুক্ত হস্তে মহারাজ দান করে গেছেন।
মহারাজ ডেকে পাঠালেন তাহের সাহেবকে। বলেন যে, “তুমি এতদিন ধরে আমাদের রাজবাড়ির সব ঘড়ি মেরামত করেছ। তুমি কি চাও তাহের?” তাহের সাহেবের চোখে তখন অশ্রুধারা থামেনা। চোখের জল মুছে বললেন , “মহারাজ! আজ আমি যা সবই আপনাদের দানে।বহুকিছু আমি পেয়েছি আপনাদের কাছ থেকে। আপনাদের ভালবাসা আর দানে আমার জীবন সার্থক। নতুন করে আমি আর কিছুই চাই না।” মহারাজও ছাড়বার পাত্র নন। বললেন, “কিছু তোমাকে নিতেই হবে তাহের।” তাহের সাহেব বললেন ,”মহারাজ! যদি কিছু নিতেই হয় তবে আপনার বাবার একটা ছবি দিন আমায়”। মহারাজ উদয়চাঁদ তাহের সাহেবের হাতে তুলে দিলেন মহারাজ বিজয়চাঁদের একটি দুর্লভ অয়েল পেন্টিং। সেই অয়েল পেন্টিং তাহের সাহেব বুকে করে তাঁর বি সি রোডের দোকানে টাঙিয়ে রাখলেন সসম্মানে। এখন দোকানের খোলনলচে বদলে আধুনিক হয়ে গেছে, কিন্তু মহারাজার ছবিটি মর্যাদার সঙ্গে একই জায়গায় টাঙ্গানো আছে আজও। বর্ধমানের এই ঘড়িওলার কাহিনী হয়তো বর্তমান প্রজন্ম ভুলে গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে কিছু প্রবীন নাগরিক ও তাহের সাহেবের পরিবারে স্মৃতিতে।