আহমদ আবদুল্লাহ: এলজেডি ল’ কলেজে হঠাৎ করেই চেয়ারম্যান গোপাল দাস এবং সেক্রেটারি-সহ কর্তৃপক্ষ এককাট্টা হয়ে সেখানকার অধ্যাপিকা এবং ছাত্রীদের মাথায় হিজাব অর্থাৎ ইউনিফর্মের সঙ্গে কালার মিলিয়ে হেডস্কার্ফ পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। প্রথমেই এই নিষেধাজ্ঞার শিকার হন অধ্যাপিকা সনজিদা কাদির এবং বহু আশা করে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থেকে পড়তে আসা এক ছাত্রী। ছাত্রীটিকে তো পুরুষ স্টাফরা রীতিমতো বন্ধ ঘরের মধ্যে আটকে রেখে হিজাব খুলে ফেলার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু ওই ছাত্রী নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঈমান বিক্রি করে তাঁদের কথা মতো মাথায় পরিধান করা কাপড় খুলতে রাজি হয়নি। আর প্রবল চাপের মুখে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সনজিদা শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের কথায় চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এই সব কথা ‘পুবের কলম’-এ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
চেয়ারম্যান গোপাল দাস তাঁর কলেজে হঠাৎই হিজাব নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ হিসেবে যা বলেন তা হল, এই কলেজ কোনও রিলিজিয়াস ইন্সটিটিউশন নয়। রিলিজিয়াস ইন্সটিটিউশন হলে হিজাব পরে আসা যেত। এই কলেজে আমরা নিউট্রাল স্পেস তৈরি করতে চাই। এখানে কোনও ধর্মের কার্যকলাপ চলবে না।
হঠাৎ তাঁদের এই বোধোদয় কেন হল, তার অবশ্য কোনও ব্যাখ্যা গোপালবাবু এবং তাঁর সহযোগীরা দেননি। তবে একটি কারণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, অধ্যাপিকা সনজিদাকে মাথা আবৃত করে আসা যাবে না এই নিদান জারি করা হয় ৩০ মে, ২০২৪। তারপর ক্রমাগত তাঁকে চাপ দেওয়া হতে থাকে যে, আপনি যদি মাথা আবৃত করা না ছাড়েন, তাহলে আপনাকে একদিনের জন্যও ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হবে না। চেয়ারম্যান গোপাল দাস এবং অফিস অ্যাডমিন অশোক দাসের ক্রমাগত চাপের ফলে পরবর্তীতে অধ্যাপিকা তাঁর ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হন।
মনে রাখতে হবে, ৪ জুন, ২০২৪ ছিল লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বের হওয়ার তারিখ। আর সমস্ত মিডিয়া, টিভি চ্যানেল, প্রিন্ট মিডিয়া সকলেই সমানে প্রচার করছে মোদি আসছেন বিপুলভাবে। আর পশ্চিম বাংলায় দিদি হারছেন বিজেপির কাছে। একজন অভিভাবক ‘পুবের কলম’-কে বললেন, হয়তো গোপালবাবুরা ভেবেছিলেন এই সময় যদি তাঁরা তাঁদের কলেজে হিজাব নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, তবে তা গেরুয়াপন্থীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় বলে প্রতিভাত হবে। তিনি নয়া নির্বাচিত সাংসদদের কাছেও বাহবা পাবেন বাংলা এবং সারা ভারতে। কিন্তু লক্ষণীয় হল, গোপালবাবুরা এই সময় মরিয়া হয়ে কলেজে হিজাব নিষিদ্ধ করার জন্য উঠে-পড়ে লাগেন।
অভিভাবকের মতে, এটাও হতে পারে গোপালবাবুদের হিজাব নিষেধাজ্ঞা জারি করার অন্যতম কারণ। যদিও হিজাবে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নিউট্রাল স্পেস বিঘ্নিত হচ্ছে বলে দাবি করলেও ওই কলেজে কিন্তু জোরেশোরে বীণাপাণিদেবীর পুজো হয় এবং দোল খেলা হয় প্রতি বছর। যাতে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপস্থিতিও অপরিহার্য। খাওয়ানো হয় সবাইকে পুজোর প্রসাদ। গোপালবাবুকে এ কথা বলতেই তিনি হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠেছিলেন। কিন্তু পরে আমতা আমতা করে বলেন, ওগুলি তো ছাত্রছাত্রীরা করে। তাও করে কলেজের বাইরের মাঠে। ভালো কথা।
‘পুবের কলম’ পত্রিকার কাছে বেশ কয়েকটি ছবি রয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে কলেজের মাননীয় চেয়ারম্যান সাহেব পরিবার-পরিজনদের নিয়ে কলেজে অনুষ্ঠিত সরস্বতী পুজোয় অংশগ্রহণ করেছেন। কলেজের ভিতর দোল খেলারও ছবি এবং ভিডিয়ো রয়েছে ‘পুবের কলম’-এর কাছে। অবশ্য চেয়ারম্যান সাহেব পুজো-আরাধনা এসব করতেই পারেন। ভারতীয় সংবিধান তাঁকে সেই অধিকার দিয়েছে। কিন্তু কলেজে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান হবে না, কলেজ হবে নিউট্রাল স্পেস ইত্যাদি ইত্যাদি কথাগুলি যে সম্পূর্ণ ভুয়ো ও বানোয়াট তা বলে দেবে এই পত্রিকায় প্রকাশিত দু’টি ছবি। আর অশোক দাস তো রীতিমতো আগুন জ্বেলে বীণাপাণিদেবীর সামনে স্বয়ং পুজো করতে বসেছেন। তাও আবার কলেজের ভিতরে একটি কক্ষে। অবশ্য এতে সম্ভবত ‘নিউট্রাল স্পেস’ নষ্ট হয় না!
এই খবরটি ১০ জুন, ২০২৪ একটি প্রথম শ্রেণির বাংলা দৈনিক পত্রিকা ও ‘পুবের কলম’-এ প্রকাশিত হওয়ার পর পশ্চিম বাংলায় সাড়া পড়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন সংগঠন এই ধরনের জুলুমবাজির বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করে বিক্ষোভের হুঁশিয়ারি দেয়।
এই সময় পশ্চিম বাংলার বিধায়ক হুমায়ুন কবীর সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, মুসলিম অধ্যাপিকা ও ছাত্রীদের উপর এই ধরনের অন্যায় হলে তা উচ্চশিক্ষায় মুসলিম পড়ুয়াদের নিরুৎসাহিত করবে। আর জোর করে হিজাবে নিষেধাজ্ঞা ভারতের সংবিধানেরও উল্লঙ্ঘন। এটাকে রুখতে হবে। তিনি ‘পুবের কলম’ থেকে অধ্যাপিকা সনজিদা কাদির ও কলেজের চেয়ারম্যান গোপাল দাসের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন।
বিধায়ক এবং এক সময়ের আইপিএস অফিসার হুমায়ুন সাহেব স্থির করেন, তিনি ওই অধ্যাপিকাকে নিয়ে চেয়ারম্যান গোপাল দাসের সঙ্গে দেখা করবেন এবং কলেজ কর্তৃপক্ষকে সনজিদা কাদিরকে পুনরায় অধ্যাপনায় ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। সেই অনুযায়ী হুমায়ুন সাহেব অধ্যাপিকা সনজিদাকে নিয়ে কলেজে উপস্থিত হন এবং যুক্তিপ্রদান করে অধ্যাপিকাকে ফিরিয়ে নিতে চেয়ারম্যান গোপাল দাসের উপর চাপ সৃষ্টি করেন।
কিন্তু চেয়ারম্যানের মনোবাঞ্ছা মতো অধ্যাপিকা সনজিদা কোনও চিঠি লিখে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বরং আপনাদেরকে চিঠি দিয়ে আমাকে বলতে হবে যে, আমি হেডস্কার্ফ পরে কলেজে জয়েন করতে পারব। আর যে সমস্ত ছাত্রীরা হিজাব পরে আসবেন তাঁদেরকেও ক্লাসে অ্যালাও করতে হবে।