দেবিকা মজুমদার: বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চাই জ্বালানি। সেই জ্বালানি অর্থাৎ কয়লার জন্য কয়েকবছর আগেও কেন্দ্রের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে থাকতে হত রাজ্যকে। প্রয়োজনীয় কয়লার প্রায় ৮০ শতাংশ আসত কোল ইণ্ডিয়ার কাছ থেকে। তবে– এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। বর্তমানে রাজ্যের পাঁচটি কয়লা খনি থেকে প্রয়োজনীয় জ্বালানির প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ হয়ে যায়। তাই– কোল ইণ্ডিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমে এসেছে ৩০ শতাংশে। বৃহস্পতিবারই একথা জানিয়েছিলেন ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভলপমেন্টের সিএমডি পি বি সালিম। তবে– খুব শীঘ্রই সেটুকু নির্ভরশীলতারও প্রয়োজন হবে না পশ্চিমবঙ্গের। পুবের কলমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন পিবি সালিম।
প্রসঙ্গত– কয়েক মাস আগেই বীরভূমের দেউচাপচামির কয়লাখনি চালু করার কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেসময় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন– দেউচাপচামির কয়লাখনিটি চালু হলে পশ্চিমবঙ্গ কয়লা অন্যান্য রাজ্যকে বিক্রি করতে পারবে।
গোটা দেশে যখন কয়লা নিয়ে হাহাকার চলছে ঠিক সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ মন্ত্রকের তরফ থেকে জানানো হয়– এখনো পর্যন্ত রাজ্যে কয়েক লক্ষ মেট্রিক টন কয়লা মজুত রয়েছে। তাই– রাজ্যবাসীকে বিদ্যুৎ পরিষেবা দিতে কোনো সমস্যা হবে না। বরং এই পরিস্থিতির মধ্যেও কয়লায় নিজেকে স্বাবলম্বী করার পথে অগ্রসর হচ্ছে রাজ্য। এপ্রসঙ্গে এদিন পিবি সালিমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান– ২০১৮-১৯ সালের পর কোল ইণ্ডিয়ার ওপর থেকে ধীরে ধীরে আমাদের নির্ভরশীলতা কমতে থাকে। ২০১৯ সালে আমাদের প্রথম কয়লাখনিটি আমরা চালু করতে পারি। এরফলে ২০২০ সালে কোল ইণ্ডিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা ৮০ শতাংশ থেকে কমে ৫৫ শতাংশে এসে যায়। তারপরে গতবছর আমরা আরও চারটি কয়লাখনি চালু করি। বর্তমানে রাজ্যের নিজস্ব পাঁচটি কয়লাখনি চালু রয়েছে। এরফলে কোল ইণ্ডিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমে হয়েছে ৩০ শতাংশ।
তবে– এখানেই শেষ নয় খুব শীঘ্রই চালু হবে আরও দুটি কয়লাখনি। এই প্রসঙ্গে পিবি সালিম আরও বলেন– আগামী তিন মাসের মধ্যেই আরও একটি কয়লাখনি চালু হতে চলেছে। বীরভূমের তারা ইস্ট অ্যাণ্ড ওয়েস্ট নামে একটি কয়লা খনি রয়েছে– যেটি ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারী থেকে ফেব্র&য়ারীর মধ্যেই চালু হয়ে যাবে। এই কয়লাখনিটি চালু হলে কোল ইণ্ডিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা আরও ১৫ শতাংশ কমবে।
তিনি আরও বলেন– তারা ইস্ট অ্যাণ্ড ওয়েস্ট কয়লাখনির পরে আমাদের লক্ষ্য বীরভূমের দেউচাপচামির একটি অংশ চালু করা। ২০২৩ সালের মধ্যই এই কয়লাখনিটি চালু করা হবে। এটি আমাদের দেশের সবথেকে বড় কয়লাখনি। তবে– এই ব্লকটি চালু করা খুবই কঠিন। তার কারণ–৭০০ মিটার গভীর পর্যন্ত পাথর থাকায় এই কয়লাখনিটি চালু করতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই কয়লা খনিটি আজ থেকে দশ বছর আগে ২০১০-১১ সালে কোল ইণ্ডিয়াকে দেওয়া হয়। কোল ইণ্ডিয়া দু’বছর এই কয়লাখনি নিজেদের হাতে রাখে– কিন্তু কয়লাখনিটি চালু করতে পারে না। এরপরে কোল ইণ্ডিয়া এই কয়লাখনিটি সারেণ্ডার করে। ২০১৫ সালে তিন-চারটি কোম্পানীকে একত্রে (জয়েন্ট ভেঞ্চারে) এই কয়লাখনির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল তামিলনাড়ুর নেইভেলি লিগনাইট কর্পোরেশন– পাঞ্জাব পাওয়ার ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন সহ আরও কয়েকটি কোম্পানী। তারাও দু’-তিন বছর চেষ্টা করে। যদিও কোনও কাজ এগোয় না। এরপরে তারাও সারেণ্ডার করে দেয়।
পিবি সালিম আরও বলেন– কয়েক মাস আগে এই কয়লাখনি আমাদের হাতে আসে। ইতিমধ্যেই সার্ভে করা হয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা করেছিলেন পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার পরেই ওই কয়লাখনিতে কাজ শুরু হবে। সেই নির্দেশ অনুযায়ী– ওখানের আশেপাশের স্থানীয় বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের প্যাকেজ কি হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি কয়লা খনির কাজে যোগ্যতা অনুযায়ী– স্থানীয় বাসিন্দাদের কাজের সুযোগও দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করবেন কত টাকার প্যাকেজ দেওয়া হবে পুনর্বাসনের জন্য। পুর্নবাসনের কাজ শেষ হয়ে গেলে খুব শীঘ্রই এই কয়লাখনি চালু করার কাজ শুরু হবে। কেন্দ্র সরকার আমাদের পাঁচ বছরের সময়সীমা দিয়েছে এই কয়লাখনিটি চালু করার জন্য। আমরা ঠিক করেছি– একবারে পুরোটা চালু না করে এক-একটি অংশ করে চালু করব। আগামী দু’বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দেউচাপচামির ছোট অংশ দেওয়ান সিং হরি সিং-এ কাজ শুরু করা হবে। এই অংশটি চালু হলে কোল ইণ্ডিয়া ওপরে কয়লার জন্য আর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না রাজ্যকে। বরং আমরা বাইরের রাজ্যকে এবং কোল ইণ্ডিয়াকে কয়লা বিক্রি করতে পারব। এরফলে রাজ্যের ওপর চেপে থাকা ঋণের বোঝা নামাতে সাহায্য হবে।
পাশাপাশি– দেশজুড়ে চলতে থাকা কয়লা সংকট প্রসঙ্গে পিবি সালিম বলেন– কয়লা সংকটের কারণ হতে পারে কয়লার উৎপাদন কমার বিষয়টি। কয়লার উৎপাদন কমার কারণ হতে পারে জ্বালানি হিসাবে কয়লার পরিবর্তে অন্য বিকল্প খোঁজার প্রচেষ্টা। পাশাপাশি করোনার কারণেও কয়লার উৎপাদন কমে যায়। কোভিডের কারণে তাপবিদ্যুৎশক্তির চাহিদা কমে যায়। যার ফলে কয়লার উৎপাদনও কম হতে থাকে। তাই– কয়লার সম্পূর্ণ উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে তাপবিদ্যুৎশক্তির চাহিদা আগের থেকে অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। যার সঙ্গে পাল্লা দিতে আবার সমস্যায় পড়ছে কয়লাখনিগুলি। তাই এই কয়লা সংকট।