রমিত বন্দ্যোপাধ্যায়: বাস্তবজীবনের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে ‘শ্রীকান্ত’ নামক বায়োপিক। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় ১১০ জন দৃষ্টিহীনকে ‘শ্রীকান্ত’ সিনেমাটি দেখানোর ব্যবস্থা করল ভিসুয়াললি ইমপেয়ারড ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল (ভি.আই.সি.এ.বি)। শুক্রবার ১০ মে ‘টি সিরিজের’ সহযোগিতায় এক অনাবিল মুহূর্তের সাক্ষী থাকল কলকাতার সাউথ সিটি মল। শ্রীকান্ত বোল্লা-র উপর তুষার হিরানন্দানির এই বায়োপিক মন কেড়েছে অনেক দৃষ্টিহীন এবং দৃষ্টিমান দর্শকের। ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো-এর উত্তেজনা ছিল প্রবল।
এই দৃষ্টিহীন দর্শকদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক, শিক্ষক, স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, আধিকারিক, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত দৃষ্টিহীন মানুষেরা।
এই সকল দৃষ্টিহীন দর্শকের পাশাপাশি ছিল দৃষ্টিমান দর্শকেরাও। এই সিনেমাটির মূল চরিত্রে অভিনয় করেন রাজকুমার রাও। রাজকুমার রাও-এর অভিনয় এই দৃষ্টিহীন দর্শকেরা দেখতে না পেলেও রাজকুমারের গলার আওয়াজ এবং শব্দের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছে অনেকেই। অনেকেই নিজেদের জীবনের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছে রাজকুমারের অভিনীত চরিত্রে। কখনও তাদের হাসতে দেখা যায়, আবার কখনো তাদের ভালো লাগার প্রকাশ ঘটে করতালির মাধ্যমে। কখনও আবার সিনেমার কিছু দৃশ্যে তাদের ফোঁপানি এবং কান্নার শব্দও শোনা যায়। নবীন-প্রবীণ সমস্ত বয়সের দৃষ্টিহীন দর্শকদের নিয়ে এক আবেগ ভরা স্মরণীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকী ন’মাসের এক শিশুকে সঙ্গে নিয়ে এক দৃষ্টিহীন দম্পত্তিকে দেখা যায় এই সুন্দর মুহূর্তকে সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে।
সিনেমা দেখার সহযোগিতার জন্য কিছু কিছু দৃষ্টিহীন দর্শকের সঙ্গে একজন করে দৃষ্টিমান সঙ্গীও আসেন।
‘শ্রীকান্ত’ নামক এই বায়োপিক ১৯৯২ সালে ৩রা জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশে জন্মগ্রহণ করা শ্রীকান্ত বোল্লা নামক এক দৃষ্টিহীন বালকের জীবনীর ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়। এই সিনেমায় ছিল এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশু কীভাবে শিল্পপতি হিসাবে জাতীয় মঞ্চে যাত্রা করল।
প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত দৃষ্টিহীন দর্শকদের মধ্যে কয়েকজনের প্রথমবার সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা হয়। প্রথম বর্ষের এক ছাত্র শিবনাথ মাহাতো জানায়, আমার এই প্রথমবার সিনেমা হলে এসে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা হল। এমন ভালো সাউন্ড কোয়ালিটি হতে পারে, সেটা আমি কখনও ভাবতেও পারিনি। মনে হচ্ছিল, যা ঘটছে, তা সবই সামনে হচ্ছে।
রমেশ বেড়া নামে পূর্ব মেদিনীপুর এক দৃষ্টিহীন শিক্ষক জানালেন, ‘প্রতিবন্ধকতা মানে পিছিয়ে যাওয়া নয়। সমাজকে আরও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে, তবেই আমরা একইভাবে উন্নতি করতে পারবো।’
দেবকুমার দণ্ডপাট বিজয়গড় কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর জানালেন, আমাদের অনেকের সঙ্গে একজন করে দৃষ্টিমান সঙ্গী এসেছেন। আমাদের মতো দৃষ্টিহীনদের সঙ্গে যদি দৃষ্টিমানরা ভবিষ্যতে আরও সিনেমা দেখার সুযোগ তৈরি করেন, তবে তাঁদের সঙ্গে আমাদের একটা ইন্টিমেসি আর ইন্টারপার্সোনাল রিলেশনশিপ গড়ে উঠবে। তাতে সমাজের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বাড়বে বলে আমি আশা করছি।
নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির প্রাক্তন প্রিন্সিপাল বিশ্বজিৎ ঘোষ জানান, এখনও বহু স্কুলে সায়েন্স নিয়ে পড়া তো দূরের কথা একজন দৃষ্টিহীন ছাত্রের ক্ষেত্রে একটা স্কুলে অ্যাডমিশন নেওয়াটাও খুবই কঠিন ব্যাপার।
ভি.আই.সি.এ.বি-র সচিব চন্দন মাইতি বলেন, এখানে দেখানো বেশকিছু লড়াইয়ের সঙ্গে আমরা পরিচিত। এই ছবি সমাজকে একটা বার্তা দিতে পারে এবং সমাজকে দৃষ্টিহীনদের ব্যাপারে অবগতও করতে পারে। আমাদের এই সিনেমাটা দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমরা টি-সিরিজের কাছে কৃতজ্ঞ এবং তাদের ধন্যবাদ জানাই।