এ হাসান: শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ‘সিপিএম আছে সেই সিপিএমেই’। দেশে এখন তিন মাস ব্যাপী লোকসভা নির্বাচন চলছে। বিশেষজ্ঞরা এই নির্বাচনকে বলেছেন, ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র এবং নাগরিক অধিকারের জন্য এক মরণ-বাঁচন নির্বাচনী লড়াই। বিরোধী দলগুলিও এই বিষয়টি ভালোরকম বুঝতে পেরেছে। তাই তারা ইন্ডিয়া জোট করেছে। কিন্তু কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরি পশ্চিমবাংলায় এই জোটকে প্রাধান্য দেননি। তিনি এমন সব দাবি (১৬টি আসন), কথাবার্তা বলেছেন যার ফলে তৃণমূল কংগ্রেস বাংলায় এই জোট সমর্থন করেনি। আর সিপিএম তারা হাত মিলিয়ে অধীর রঞ্জন চৌধুরির সঙ্গে।
আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে নিজেদের ঘোষিত বিজেপি ও এনডিএ বিরোধী অবস্থান থেকে সরে গিয়ে সিপিএম এমন সব কাজ করছে, যাতে দেশে ফ্যাসিবাদী মহলেরই সুবিধা হয়ে যাচ্ছে।
একটি উদাহরণ হচ্ছে, সিপিএম নেতা এবং বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য তাঁর কমরেডি অবস্থানেই রয়ে গেছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে যিনি সবথেকে বেশি সরব, যিনি সারা ভারতকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে প্রেরণা দিচ্ছেন সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিজেপি নয়, মামলা ঠুকেছে সিপিএম। আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য কলকাতা হাইকোর্টে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করার জন্য আবেদন করেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপরাধ হচ্ছে, বর্তমানে বিজেপি যেভাবে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে, তা সকলেরই জানা। আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, এমন কিছু রায় বিচার ব্যবস্থা থেকে সামনে আসছে যা আইন বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, একপেশে এবং এক বিশেষ রঙে রঞ্জিত।
বাবরি মসজিদ রায়ের সময় দেখা গেছে, সর্বোচ্চ আদালত আইন না দেখে সংখ্যাগুরুর আস্থা অনুযায়ী রায় দিয়েছে। আর রায়ের পরই কয়েকজন বিচারককে মোদি সরকারের অনুগ্রহের ফসল তুলতে দেখা গেছে। যেমন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। তিনি অবসরের পর পরই রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়েছেন। আর এক বিচারপতি এস নাজির আহমেদকে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল হিসেবে ‘বরণ’ করা হয়েছে।
এই সম্পর্কিত আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। ইলাদাবাদ হাইকোর্টের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে যে সমস্ত রায় আসছে, তা এক পক্ষেরই সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে। তিস্তা শেতলাবাদের মতো অনেক সমাজকর্মীকে মিথ্যা অভিযোগে জেলে পাঠানো হচ্ছে, বহুদিনের হাজত বাসের পর সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে তাঁরা জামিন পাচ্ছেন কিংবা জামিনের আবেদন করে অপেক্ষায় রয়েছেন। বহু দণ্ডিত অপরাধীকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে (বিলকিস বানু মামলা, মায়া কোদনানির মুক্তি) এই ধরনের হাজারও উদাহরণ ভারতের মর্যাদাপূর্ণ বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তিকে মোটেই উজ্জ্বল করেনি।
তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, কিছু বিচারক বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বক্তব্যটিতে বিকাশবাবু ও সিপিএম নাখোশ হয়েছেন। তাঁরা এই ব্যাপারে হাইকোর্টকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। অথচ মুখে সিপিএম ফ্যাসিবাদীর বিরুদ্ধে, বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যেই মুখ খোলে। দেখা যাচ্ছে, এই মরণ-বাঁচন নির্বাচনীযুদ্ধে প্র্যাক্টিক্যালি সিপিএম বিজেপিকেই সুবিধা করে দিচ্ছে, বিশেষ করে বাংলায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাই সোমবার নির্বাচনী প্রচারে বলেছেন, মুর্শিদাবাদ, রায়গঞ্জ, মালদহে কংগ্রেস-সিপিএম প্রার্থী দিয়ে বিজেপি বিরোধী প্রধান শক্তি তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটবাক্সে থাবা বসানোর জন্য প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। এর ফলে তারা বিজেপিকেই জেতানোর লক্ষ্যে কাজ করছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, তৃণমূল প্রার্থীরা জিতলে আপনাদের জন্য কাজ করবে। তাই ভোট কাটাকাটিতে যাবেন না। তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার করছে। বিজেপি জিতলে প্রকৃত ধর্মের অস্তিত্ব থাকবে না। তারা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করবে, সিএএ, এনআরসি করবে। কাজেই সংখ্যালঘুদের প্রতিটি যেন তৃণমূল পায় তার জন্য ভোট কাটাকাটিতে শরিক হবেন না। এবার বিজেপি ২০০ আসনও পার হবে না।
তাই সকলেই বলছেন, বাংলায় সিপিএম রয়ে গেছে সেই ৩৪ বছরের পুরনো সিপিএমেই। বাংলায় কংগ্রেস-সিপিএম জোট ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইতে বিজেপিরই ফায়দা করে দিচ্ছে।