আহমদ আবদুল্লাহ: লস্কর-ই-তাইয়েবা। একটি জঙ্গি সশস্ত্র, ভয়ংকর সংগঠন! এর কর্ম তৎপরতা অবশ্য সারা পৃথিবীতে নয়, শুধুমাত্র এই উপমহাদেশে। অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ। মাঝখানে বহুদিন লস্কর-ই-তাইয়েবা-র নাম শোনা যায়নি। কিন্তু ভোট এলেই লস্কর-ই-তাইয়েবা জিন্দা হয়ে ওঠে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সংগঠনটি তার অশুভ তৎপরতা ফের শুরু করেছে। আর শুরু করবি তো করবি তাও আবার এই সুজলা সুফলা বাংলায়!
রবিবার লস্কর-ই-তাইয়েবা কলকাতার ২০০টি স্কুল বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। তবে সেটা সম্ভবত ছাত্রছাত্রী ভর্তি স্কুলে নয়, নির্বাচনের সময় বহু স্কুলে ভোট গ্রহণ কেন্দ্র খোলা হয় সেই সময়ই। খানিকটা রক্ষে, আগাম জানিয়ে দেওয়ায় পুলিশ, এনআইএ সবাই সতর্ক হয়ে গেল এবং এটা আশা করার সংগত কারণ রয়েছে যে, লস্কর-ই-তাইয়েবা-র হুমকি হুমকিই থাকবে। ইতিমধ্যেই আমাদের পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী তাদের দফারফা হয় সাঙ্গ করবে, নয়তো খেদিয়ে ৩,০০০ মাইল দূরে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেবে।
কিন্তু না লস্কর-ই-তাইয়েবা এখানেই থেমে নেই। সোমবারই তারা এক ‘পত্রবোমা’ পাঠিয়েছে বনগাঁর বিজেপি প্রার্থী ও বিজেপি সমর্থিত মতুয়া মহাসংঘের সংঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুরকে। তাদের চিঠিতে লেখা আছে, ‘শান্তনুবাবু আশা করি ভাল আছেন। আপনাকে জানাচ্ছি যে, পশ্চিমবঙ্গে যদি এনআরসি হয় এবং এনআরসি-র কারণে মুসলমানদের উপর কোনও অত্যাচার হয় তা হলে পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারত জ্বলবে। আপনাদের ঠাকুরবাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হবে। ঠাকুরবাড়ির কাউকে বাঁচতে দেওয়া হবে না।’
বড়ই ভয়াবহ চিঠি। মতুয়া বেচারারা সিএএ-র ভয়ে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বিব্রত ও চিন্তিত হয়ে আছে। তারপর লস্কর-ই-তাইয়েবা-র এই চিঠি। তাও আবার আরবি বা উর্দুতে নয়, একেবারে পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলাভাষায়। চিঠিটা কীভাবে পাঠানো হয়েছে তা অবশ্য জানা যায়নি। ইমেলে, হোয়াটসঅ্যাপে, না ডাক বিভাগের মাধ্যমে সেটা অবশ্য খোলসা করা হয়নি।
তবে লস্কর-ই-তাইয়েবা-র এই চিঠিটি যে খুবই ভীতির কারণ তা ধারণা করতে কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয়। সে সব তো সবই বোঝা গেল। কিন্তু চিঠিটি যে লস্কর-ই-তাইয়েবা-ই লিখেছে, তার প্রমাণ কী? না প্রমাণ আছে। আর তাহল লস্কর-ই-তাইয়েবা নিজেই চিঠির নিচে লিখেছে, ‘আপনি কী লস্কর-ই-তাইয়েবা-র নাম শুনেছেন? আমরাই হচ্ছি সেই লস্কর-ই-তাইয়েবা-র সদস্য।’ তাহলে লস্কর-ই-তাইয়েবা-র সদস্যরা নিজেই তাদের পরিচয় ব্যপ্ত করেছে। আর যাতে শান্তনুবাবুর কোনও স¨েহ না থাকে, সে জন্য যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে লিখেছে, ‘আপনি নিশ্চয়ই লস্কর-ই-তাইয়েবা-র নাম শুনেছেন।’ ফলে শান্তনুবাবুর সংশয় করার আর কোনও অবকাশই রইল না।
তবে চিন্তার খুব কারণ আছে? এমননিতে বিজেপি সাংসদ হিসেবে শান্তনুবাবুকে দেওয়া হয়েছে কঠোর কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তাকে আরও আঁটোসাঁটো করা হবে। আর প্রয়াত বড়মার কল্যাণে এই ঠাকুরবাড়ি মতুয়াদের কাছে তীর্থস্থান। তা উড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিরাপত্তাবাহিনীকে নিতে হবে। তবে চিঠি পড়ে বোঝা যাচ্ছে এই লস্কর-ই-তাইয়েবা ‘স্বদেশজাত দেশি লস্কর-ই-তাইয়েবা’। ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন হলেও তারা চিঠি শুরু করেছে খুবই নম্র ও বিনীতভাবে। বিজেপি সাংসদের জন্য খানিকটা শুভেচ্ছাই বলা যেতে পারে, চিঠিতে লেখা রয়েছে, ‘শান্তনুবাবু আশা করি ভালো আছেন’।
অর্থাৎ শান্তনুবাবুর ভালো থাকাটাও এই লস্কর-ই-তাইয়েবা-র কাম্য। আর তাঁরা সেটা আশা করছেন। আর তারা শান্তনুবাবুর বোঝার জন্য বিশদভাবে নিজেদের পরিচয়ও তুলে ধরেছেন। কি জানি শান্তনুবাবু যদি বুঝতে না পারেন, কারা এই হুমকি চিঠি লিখেছে।
কিন্তু সকলেই বলছে, এ কোন ধরনের হুমকির চিঠি। এর থেকে বাংলার রঘু ডাকাতের চিঠিগুলিও অনেকটা কড়া ছিল। বাংলার মাটি, জল, হাওয়ায় লস্কর-ই-তাইয়েবাও যে শান্তশিষ্ট ল্যাজ বিশিষ্ট হয়ে যাবে তা কে জানত। চিঠিটি কম্পিউটারে নয়, বরং পুরনো যুগে বাংলা টাইপ রাইটারে লেখা। সম্ভবত বাংলার লস্কর-ই-তাইয়েবা-র অর্থকড়ি তেমন নেই। লস্কর-ই-তাইয়েবা টেক স্যাভি হলেও বাংলার লস্কর-ই-তাইয়েবা-র অবস্থা খানিকটা বোধহয় তথবৈচ।
আর তারা এত ভালো নিজেদের ঠিকুজিকুষ্টিও শান্তনুবাবু তথা পুলিশ গোয়ে¨াদের পাঠিয়ে দিয়েছে। চিঠিতে প্রেরকের নাম লেখা হয়েছে, ‘নজরুল ইসলাম সাহেব আলি, ফজের আলি, সাং- হাদিপুর, দেগঙ্গা, উত্তর ২৪ পরগনা’। সবথেকে বড় কথা, লস্কর চিঠির শেষে লিখেছে, ‘ধন্যবাদান্তে, ইতি বিনীত নিবেদক’। বোঝা যায়, এই লস্কর-ই-তাইয়েবা-দের সৌজন্যবোধ প্রখর। বলতে পারা যায়, তারা ‘বিনীত’ হয়েই চিঠিটি প্রেরণ করেছে।
লস্কর-ই-তাইয়েবা-র চিঠি নিয়ে বিরাট খবর হয়েছে। হওয়ারই কথা। তবে পুলিশ ইচ্ছে করলে দেগঙ্গার এই নজরুল ইসলাম সাহেব আলি ও ফজের আলিকে খুঁজে বের করতে পারে। আশেপাশে কার বাংলা টাইপ রাইটার ছিল এবং কারা সেখানে বাংলা টাইপ করে রোজগার করত, তা একটু খবর নিলে হয়তো জানা যাবে। নিদেন এই চিঠি লেখার পর ‘বিনীত লস্কর-ই-তাইয়েবা’ ভয়ের চোটে টাইপ রাইটারটি হয়তো কোনও পুকুরে ফেলে দিতে পারে। পুলিশের উচিত হবে পুকুরগুলি সব জেলে নামিয়ে সার্চ করা। ডুবরির যে প্রয়োজন নেই তা বলাই বাহুল্য।
তবে সাবধানের মার নেই। আমরা আশা করব, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনী শান্তনু ঠাকুর, ঠাকুরবাড়ি-সহ মতুয়াদের সুরক্ষায় পুরোপুরি ধ্যান দেবেন।