উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়নগর : লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মঙ্গলবার এস ইউ সি আই দক্ষিণ ২৪ পরগনার চারটি লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থীদের সামনে রেখে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করলো। এদিন বারুইপুর জেলা অফিসে সাংবাদিক বৈঠকে জয়নগরের প্রাক্তন সাংসদ এস ইউ সি আই রাজ্য সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ডা: তরুণ মন্ডল ও জয়নগরের প্রাক্তন বিধায়ক তথা রাজ্য সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য তরুণ কান্তি নস্কর বলেন, এবারের নির্বাচনে আমাদের দল এসইউসিআই (কম্যুনিস্ট) সারা দেশে ১৫১টি এবং এরাজ্যে ৪২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই নির্বাচনে সরকার এবং বিভিন্ন দল কোটি কোটি টাকা ব্যয় করবে।
যতই গণতন্ত্রের কথা বলা হোক না কেন, মার্কসবাদী হিসাবে আমরা জানি, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নির্বাচনের দ্বারা একটা বুর্জোয়া দলের পরিবর্তে আর একটি বুর্জোয়া দল নির্বাচিত বা পুনর্নির্বাচিত হয়। এই নির্বাচনে একদিকে বিজেপির নেতৃত্বে ‘এনডিএ’ আরেকদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ‘ইন্ডিয়া’ প্রধানত এই দুইটি বুর্জোয়া জোটই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। দুই পক্ষই ভুরি ভুরি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং টাকার থলি নিয়ে এই নির্বাচনে নামবে। বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল শাসনে সারা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যে নানা সমস্যায় নিমজ্জিত।
‘মোদির গ্যারান্টি’ বলে যে দাবি প্রধানমন্ত্রী করছেন তার হাল হল,পূর্বতন প্রতিশ্রুতি বিদেশে সঞ্চিত কালো টাকা উদ্ধার করে ১৫ লক্ষ টাকা সকলকে দেবে, প্রতি বছর দুই কোটি বেকারের চাকরি দেবে, কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করবে প্রভৃতি আজ ‘জুমলায়’ পরিণত। বিজেপির রামরাজত্বে কুড়ি কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটায়, দৈনিক ১৫৪ জন কৃষক আত্মহত্যা করে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত চার লক্ষ কৃষক ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন, প্রতিদিন ৩ হাজার শিশু অপুষ্টিতে মারা যায়, স্থায়ী চাকরি নেই, কারখানা বন্ধ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন বলছেন তেলেভাজা শিল্প করতে, তখন প্রধানমন্ত্রী বলছেন পকোড়া শিল্প গড়তে। আর এক ‘রামরাজত্ব’ উত্তর প্রদেশে ৩৬২টি পিয়ন পদের জন্য ২৩ লক্ষ মানুষ আবেদন করেছিল, এরাজ্যে ৫৪০০ গ্রুপ-ডি পদের জন্য পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৮ লক্ষ। নারীর ইজ্জত আজ ভুলুণ্ঠিত।
কংগ্রেস ও পুঁজিবাদের আরেকটি বিশ্বস্ত দল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা কালীন অবাধ পুঁজিবাদী শোষণ ও লুন্ঠনকেই কার্যকরী করেছে। কংগ্রেস কোনও দিনই ‘সেক্যুলার’ ও ‘গণতান্ত্রিক’ ছিল না, কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য নিছক কিছু সিট পাওয়ার স্বার্থে সিপিএম ও সিপিআই এই কংগ্রেসকেই ‘সেক্যুলার’ এবং ‘গণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে ইন্ডিয়া জোটে সামিল হয়েছে। অথচ এই সময় প্রয়োজন ছিল শোষিত জনগণের শ্রেণি সংগ্রামকে ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আরও তীব্রতর করার জন্য সংগ্রামী বাম ঐক্য গঠন করা এবং তার মাধ্যমেই এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা।
পশ্চিম বঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ‘পরিবর্তন’ এর শ্লোগান তুলে যে শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে সেটা নিছক তাদের দলীয় শাসন প্রবর্তন করা। দলবাজি, আন্দোলনের উপরে আক্রমণ, চরম দুর্নীতি, পুলিশ ও প্রশাসনকে কবজা করে সমাজ বিরোধীদের বাবহার করে দলীয় আধিপত্য কায়েম করা, নগ্নভাবে ভোটে জোরজুলুম ও জালিয়াতি – এসবই চলছে।
এরাজ্য নারী পাচারে ভারতবর্ষে শীর্ষ স্থানে আছে। চুরিডাকাতি, ছিনতাই, তোলাবাজী, ইভটিজিং, নারীধর্ষণ, এসব কিছুই অবাধে চলছে এবং যারা এইসব কুকর্ম করছে, সকলেই বেপরোয়া, কারণ তারা জানে সরকারী দলের আশ্রয়ে থাকলে বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই। কেন্দ্র যেমন পেট্রোল ডিজেলে ট্যাক্স বসাচ্ছে, এই রাজ্য সরকারও সেস বসাচ্ছে। গোটা ভারতবর্ষের মতোই এরাজ্যও শিক্ষা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপর্যন্ত।
কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত।তাই মানুষ চায় অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, কিন্তু তৃণমূল অতীতের কংগ্রেস ও সিপিএমের পদাংক অনুসরণ করে ভোট জালিয়াতিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে তা গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষ দেখেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেও এই জেলায় তৃণমূল ইতিমধ্যেই গুণ্ডাগিরি শুরু করেছে। বাসন্তী, ভাঙড়, ক্যানিংয়ে তার নমুনা পাওয়া যাচ্ছে। গত ২২ মার্চ বাসন্তীর ভরতগড় বাজারে আমাদের দেওয়াল লিখন জোর করে বন্ধ করেছে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে দেশ-জুড়ে বিরোধীদের দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে ইডি-সিবিআই লাগিয়ে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে শাসক বিজেপির সাহায্য করছে। যেন বিজেপির নেতারা ধোয়া তুলসি পাতা – ইলেক্টোরাল বন্ড, পিএম কেয়ার, ব্যাপম কেলেঙ্কারি এসবের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেই।আমাদের এই জেলার ৪ জন প্রার্থীই নতুন প্রার্থী। যাদবপুর কেন্দ্রের প্রার্থী কল্পনা দত্ত নারীর অধিকার রক্ষার আন্দোলনের সর্বভারতীয় স্তরের নেত্রী। জয়নগর কেন্দ্রের প্রার্থী নিরঞ্জন নস্কর যুব আন্দোলনের সর্বভারতীয় নেতা।
মথুরাপুরের প্রার্থী বিশ্বনাথ সরদার হকার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দিন-মজুরদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের একজন নেতা। ডায়মণ্ড হারবারের প্রার্থী রামকুমার মণ্ডল নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও ছাত্র-যুবদের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে তোলার আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এদিনের ইশতেহারে থাকা কয়েকটি হল – ১) সুন্দরবন এলাকায় শ্রম নির্ভর শিল্প স্থাপন করতে হবে। ফলতা ফিটেড্ জোনের সমস্ত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে।২) সারের কালোবাজারি বন্ধ, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতির দাম কমাতে হবে। উৎপাদিত ফসলের এমএসপি আইনসঙ্গত করতে হবে।৩) শিয়ালদহ দক্ষিণের সমস্ত শাখায় ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং প্ল্যাটফর্মগুলো উঁচু করতে হবে। প্রস্তাবিত জয়নগর থেকে রামগঙ্গা ভায়া রায়দিঘী রেলপথ স্থাপন করতে হবে।বজবজ পূজালী বিড়লাপুর-রায়পুর হয়ে ফলতা পর্যন্ত রেল পরিষেবা গড়ে তুলতে হবে।৪) সুন্দরবনকে বাঁচাতে সুউচ্চ কংক্রিটের নদী বাঁধ তৈরি করতে হবে।৫) সুন্দরবনবাসীর জীবন জীবিকা হরণকারী আইন চালু করে জলে জঙ্গলে মাছ কাঁকড়া ধরার অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না।৬) জনবিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ সহ সমস্ত কালাকানুন বাতিল করতে হবে।