মোল্লা জসিমউদ্দিন: বুধবার বহু চর্চিত এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলার শুনানি শেষ হলো কলকাতা হাইকোর্টের বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চে। তবে রায়দান স্থগিত রাখা হয়েছে বিচারপতি দেবাংশু বসাকের ডিভিশন বেঞ্চ এর তরফে। এই বেঞ্চে অপর বিচারপতি হলেন মহঃ শব্বর রসিদি। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত হয় এই বিশেষ বেঞ্চ। গত ৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় শুনানি। প্রায় সাড়ে তিনমাস শুনানি চলে।এসএসসি-র গ্ৰুপ-সি, গ্ৰুপ-ডি, নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির নিয়োগে শূন্যপদের চেয়ে অতিরিক্ত নিয়োগের অভিযোগ ছিলই। সমগ্র নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের দাবিও উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এবার এই বিষয়ে তাত্পর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ সামনে আনল কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ। সুপ্রিম নির্দেশে কলকাতা হাইকোর্টে গঠিত হয়েছে বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ। টানা সাড়ে তিন মাস ধরে সেখানেই চলছে নিয়োগ মামলার শুনানি। বুধবার ওই টানা শুনানি শেষ হল। তবে রায়দান কবে হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এদিন এই প্রসঙ্গে বিশেষ বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, ‘অতিরিক্ত নিয়োগ সরাসরি বাতিল হওয়া উচিত। কারণ, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে ভাল কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন।’আইনজীবীদের একাংশ মনে করছেন যে, -‘শূন্যপদের চেয়ে অতিরিক্ত নিয়োগের যে ঘটনা ঘটেছে তা বাতিল করা হতে পারে’। সম্ভবত, সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন বিচারপতি বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রসিদির বেঞ্চ।
উল্লেখ্য, নিয়োগ মামলার শুনানিতে গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি, নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশের সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুনর্মূল্যায়ন হতে পারে বলে গত ১৪ মার্চই ইঙ্গিত দিয়েছিল বিশেষ বেঞ্চ। এর আগে মামলার শুনানিতে স্কুল সার্ভিস কমিশন আদালতে জানিয়েছিল, -‘তাঁদের কাছে ওএমআর শিট নেই। তবে সিবিআই-এর জমা দেওয়া ওএমআর শিট এবং ইন্টারভিউয়ের নম্বরের ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুনর্মূল্যায়ন সম্ভব’।এরপরই আদালত জানিয়েছিল, -‘এসএসসি নিজে যদি ওই ওএমআর শিট নিয়ে নিশ্চিত না হতে পারে, তবে আদালত কেমন করে কোনও সিদ্ধান্ত নেবে?’এরপরই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাকের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছিল, -‘দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হয়ে গেলে হয় গোটা নিয়োগ বাতিল করে দেওয়া হবে।
নয়তো, নিয়োগের অংশবিশেষ বাতিল করা হবে’। বিতর্কিত চাকরিপ্রাপকদের আইনজীবী স্কুল সার্ভিস কমিশনের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর দাবি , -‘ কমিশনের কারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত? তা প্রকাশ্যে আসা দরকার। কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন আছে’। এই প্রসঙ্গেই বিচারপতি বসাক বলেন, -‘কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যদি প্রশ্ন থাকে তাহলে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে দেওয়া উচিত’।বুধবার শুনানি শেষ হয়েছে। এখন দেখার এ ব্যাপারে কলকাতা হাইকোর্টের বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ চূড়ান্ত কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে?রায় ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছে।
এসএসসির নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার শুনানির শেষে বিচারপতি দেবাংশু বসাক বলেন, -‘এই নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে ভালো কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন’। এসএসসির নিয়োগ সংক্রান্ত একাধিক মামলা দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা হাইকোর্টে সিঙ্গল বেঞ্চ, ডিভিশন বেঞ্চে ঘুরেছে। এইসব মামলা তৎকালীন বিচারপতি অভিজির গঙ্গোপাধ্যায় এবং বিচারপতি অমৃতা সিনহা এজলাসেও চলে । তারপর তা সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট থেকে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে এব্যাপারে বেঞ্চ গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
সেই বেঞ্চ গঠনের পর শুনানি চলল প্রায় সাড়ে তিনমাস।এদিন মামলাকারীদের আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য ও ফিরদৌস শামিম জানান , -‘ ঘোষিত শূন্যপদের থেকেও বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হয়েছে’। সেই সময় বিচারপতি দেবাংশু বসাক বলেন, -‘অতিরিক্ত নিয়োগ সরাসরি বাতিল হওয়া উচিত’। আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, -‘ অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। প্রশাসনিক স্তরে যে আধিকারিকরা যুক্ত তাদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ করা হোক।
এই সব টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক’। বিষয়টিকে সুপরিকল্পিত অপরাধ বলে বর্ণনা করেন তিনি। সেই সময় বিচারপতি বসাক বলেন, -‘বিধিবদ্ধ সংস্থার আধিকারিকদের জন্য ফৌজদারি মামলা তো আছেই’।মালকারীদের আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, -‘এই মামলার প্রেক্ষিতে আদালত যদি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ না নেয় তাহলে এই অপরাধপ্রবণতা কমবে না। অপরাধীরা এই ধরনের অপরাধ করতেই থাকবে’। সেই সময় চাকরি প্রাপকদের আইনজীবী প্রমিত রায় বলেন, -‘এসএসসি এবং সিবিআই কেউই বিশ্বাসযোগ্য নয়’। তখনই বিচারপতি বসাক প্রশ্ন করেন, -‘তাহলে কাকে বিশ্বাস করব আমরা?’ সেই সময় চাকরি প্রাপকদের আইনজীবী বলেন, -‘আদালত নিজের স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তের ওপর বিশ্বাস রাখুক’। এদিন এই মামলার শুনানি পর্বে সওয়াল জবাবে আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, -‘এই আদালত তো ওএমআর দেখার সুযোগ দিয়েছিল।
কজন এসে বলেছেন যে এই ওএমআর তাঁর নয়?’মামলাকারীদের আইনজীবীদের প্রকাশ করা অতিরিক্ত নিয়োগ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, -‘গত ২০১৬ সালে নবম-দশমের শিক্ষক নিয়োগে কমিশনের তরফে ১১,৪২৫ জনের নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু পর্ষদ ১২৯৬৮ জনকে নিয়োগপত্র দেয়। অর্থাত্ এখানে বাড়তি নিয়োগ ১৫৩৯ জনের।ওই বছরেই একাদশ-দ্বাদশে নিয়োগের সুপারিশ ছিল ৫৫৫৭ জনের। কিন্তু নিয়োগ হয় ৫৭৫৬ জন অর্থাত্ বাড়তি নিয়োগ ১৯৯ জনের। ওই বছরেই গ্রুপ সি-তে ২০৬৭ জনের নিয়োগের সুপারিশ ছিল। সেখানে নিয়োগ করা হয়েছিল ২৪৮৩ জনকে অর্থাত্ বাড়তি নিয়োগ ৪১৬ জন। গ্রুপ ডি-তে ৩৮৮১ জনের নিয়োগের সুপারিশ থাকলেও নিয়োগ করা হয়েছিল ৪৫৫০ জনকে অর্থাত্ বাড়তি নিয়োগ ৬৬৯ জনের’। যদিও মামলাকারী আইনজীবীদের এই দাবি নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটবে কলকাতা হাইকোর্টের বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চের রায়দান ঘোষণা হলেই। এখন দেখার কবে ঘোষণা হয় বহু চর্চিত নিয়োগ সংক্রান্ত মামলার রায়??