আহমদ হাসান ইমরানঃ নির্বাচনে বিজেপির প্রধান মুখ নরেন্দ্র মোদি শুক্রবার বঙ্গ সফরে আরামবাগে এসেছিলেন। সফর বলতে আরামবাগ ছিল পুরোপুরি নির্বাচনী সফর। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, নির্বাচনী প্রচার কাজ বিজেপি অনেক আগেই শুরু করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইন্ডিয়া জোট যখন কোথায়, কীভাবে জোট হবে সেই অঙ্ক কষছে, বিজেপি মোদির নেতৃত্বে নির্বাচনী ‘গেম প্ল্যান’ ছকে ফেলেছে।
আর সেই অনুযায়ী কাজও করছে। তবে বিরোধীদের জন্য আশার কথা, শেষ মুহূর্তে কংগ্রেস দল কয়েকটি রাজ্যে জোট করতে সক্ষম হয়েছে।
আর এটাও ঠিক, প্রতিটি ভোটে বিজেপি ও সংঘ পরিবার যেভাবে একের পর এক নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে, সংখ্যালঘু বিদ্বেষের জিগির তোলে, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমকে কোনও কোনও নয়া ঘটনার প্রেক্ষাপটে চাগিয়ে তোলে, তাতে দেখা যায়, বিরোধীরা এইসব প্রচারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না।
নরেন্দ্র মোদি তাঁর পশ্চিমবঙ্গে সফরে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এখানে বিজেপি, সংঘ পরিবার কোন কোন ইস্যুকে হাতিয়ার করে নির্বাচনে লড়বে। বিভিন্ন দিক থেকে পশ্চিমবাংলা এখন ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর তা হল গণতন্ত্র, সংবিধান বাঁচানো এবং যেভাবে এক দেশ এক ভোট এবং সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ ও দলিতদের অধিকার হরণের মাধ্যমে আরএসএস-এর এক পুরাতন তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করতে চাইছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে এক প্রধান বাধা।
শুধু তাই নয়, তিনি সারা ভারতে গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সংবিধানের পক্ষে শক্তিকে উজ্জীবিত করে চলেছেন। তাই বাংলাকে ফতেহ্ করতে পারলে বিজেপি ও আরএসএস-এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা সরে যাবে। তাই বাংলাকে বিজেপি এবার পাখির চোখ করেছে। আরএসএস-এর যে পুরাতন তত্ত্বের কথা বলা হচ্ছিল তাহল, মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুরা এ দেশে থাকতে পারবে। তবে তাদের নাগরিক অধিকার থাকবে না।
আর তাদের থাকতে হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের তকমা নিয়ে। তাই পশ্চিমবাংলায়, অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিএএ ও এনআরসি লাগু করার জন্য বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উঠে পড়ে লেগেছে। অসমে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে এনআরসি হয়েছে। কিন্তু তাতে কট্টর হি¨ুত্ববাদীদের খুব একটা সুবিধা হয়নি। বাঙালি হি¨ুরাই তাতে প্রধান ভিক্টিম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই লক্ষ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ কিন্তু অমিত শাহরা এক অনিশ্চিত যাত্রায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তার উপর ইদানীং শুরু হয়েছে বুলডোজার রাজনীতি। মানুষের বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এজন্য আইন, আদালতের কোনও তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না। মুসলিম ও খ্রিস্টানদের হতমান করার জন্য ৫০০ বা ৭০০ বছরের পুরাতন মসজিদ ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। মণিপুরে যেভাবে খ্রিস্টানদের গির্জা ও স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার রিপোর্ট ভারতবাসীর সামনে রয়েছে। আর সেইসঙ্গে পালটে দেওয়া হচ্ছে ইতিহাস, নাম সবকিছু। তার পরিবর্তে নিয়ে আসা হচ্ছে গেরুয়া আখ্যান ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথা হচ্ছে, পশ্চিমবাংলায় সংখ্যালঘুরা এসব জুলুম, অত্যাচার থেকে মুক্ত রয়েছে। আর এটাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির প্রধান মুখ নরেন্দ্র মোদিজির প্রধান ক্ষোভ ও আপত্তি। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, ‘একযাত্রায় পশ্চিমবাংলায় কেন পৃথক ফল হবে?’ তাই স্বয়ং মোদিজি আরামবাগে এসে বাংলার আরাম হারাম করার জন্য নানা কথা বলে গেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, পশ্চিমবাংলায় নাকি সংখ্যালঘু তোষণ হচ্ছে! তা কী তোষণ?
যেমন আরামবাগে মোদিজি বলেছেন, সন্দেশখালি কারা দুষ্কর্ম করেছে, ইডির উপর হামলা চালিয়েছে তা মুখ্যমন্ত্রী মমতার সরকার জানতেন। কিন্তু একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে আড়াল করতে গিয়ে তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। মোদি প্রশ্ন করেন, কোনটা বেশি জরুরি? একটি সম্প্রদায়কে বেশি তোষণ না মা-বোনেদের ইজ্জত? আসলে বোঝা যাচ্ছে, সন্দেশখালিতে নিয়ে পশ্চিমবাংলায় একটি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক ইস্যু খাড়া করার পরিকল্পনা হয়তো ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু তবুও ভালো, মোদিজি পশ্চিমবাংলায় এসে মুসলিমদের ইয়াদ করেছেন। তিনি বলেছেন, এবার মুসলিমরা তৃণমূলের অত্যাচারের প্রতিবাদে টিএমসিকে প্রত্যাখ্যান করবে। মোদি আরামবাগে ‘বিজয় সংকল্প’ সমাবেশে বলেন, তৃণমূলের ঔদ্ধত্য এই ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যে, তাদের একটি নিরাপদ ও সংরক্ষিত ভোট ব্যাঙ্ক রয়েছে। মুসলিম মহিলারা তৃণমূলের গুন্ডারাজকে প্রত্যাখ্যান করবেন। লোকসভা ভোটের ফলাফলের মাধ্যমেই পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল সরকারের পতন শুরু হবে।
পশ্চিমবাংলায় মুসলিম ভোট অবশ্যই একটি বড় ফ্যাক্টর। তাদের সংখ্যা পশ্চিমবাংলার মতুয়াদের থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি। সাম্প্রতিক এক হিসেব বলছে, পশ্চিমবাংলায় সাড়ে তিন কোটি মুসলিম রয়েছে। আর এ কথাও ঠিক, যেভাবে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, কর্নাটকে বিজেপি শাসিত পূর্বতন সরকার, উত্তরাখণ্ড এবং অসমে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বিজেপি সরকার মুসলিম ও খ্রিস্টানদের উপর যে অত্যাচার শুরু করেছে, তার সেইসব খবর বাংলার মুসলিমদেরও প্রভাবিত করছে। তারা জেনে বুঝে কী করে বিজেপির ঝুলিতে ভোট প্রদান করবে? তবে বিজেপি ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি এখানেও চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদিজি বাংলায় সব মুসলিমকে পদ্মে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাননি। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলার মুসলিম মহিলাদের। যেকোনোভাবে বিজেপির নীতি নির্ধারকরা মোদিজিকে বুঝিয়েছেন, মুসলিম মহিলারা বিজেপির দিকে দু’হাত বাড়িয়ে রয়েছে। আর একটা দিকও বিজেপি মুসলিম ভোট বিভাজন করতে চাইছে। আর সেটা হল, তারা বাজারে এনেছে ‘পসমন্দা মুসলিম’ থিয়োরি। মোদিজির ধারণা, যারা গরিব মুসলিম, পিছিয়ে পড়া মুসলিম তারা সহজেই বিজেপিকে ভোট দেবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মহিলা হলেও মুসলিম মহিলারা কিন্তু মুসলিম। ইসলামের প্রচার, প্রসার ও আত্মত্যাগের ক্ষেত্রে মুসলিম মহিলারাই এগিয়ে রয়েছেন। মুসলিম মহিলারা ভুলে জাননি, কীভাবে গুজরাত রাজ্যে বিলকিস বানু, জাকিয়া জাফরি এবং কাওসার বি প্রভৃতি মুসলিম মহিলাদের হত্যা, পরিবারের নিধন, ধর্ষণ প্রভৃতি নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছিল। ‘মুসলিম মহিলা’ বলে গেরুয়া বাহিনীর হাতে তাদের উপর অত্যাচার, জুলুম, হত্যা ও ধ্বংসের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। কী জানি বিজেপির কিছু নেতা হয়তো ভাবছেন, আমরা মুসলিম মহিলাদের উপর যা করেছি সেজন্য হয়তো তারা ভয়েই আমাদের ভোট দেবে।
আর যেসব মুসলিম মহিলারা বিভিন্ন দাঙ্গায় স্বামী, পুত্র, পিতার লাশ দেখেছে, তারা বিজেপিকে ভোট দেবে তা কল্পনা করা আকাশ কুসুম ছাড়া আর কিছু নয়। এ ছাড়া যে পসমন্দা বা গরিব মুসলিমদের কথা বলা হচ্ছে, যাদের প্রতি গেরুয়া-প্রেম দেখানো হচ্ছে, যাদের মুসলিম সমাজ থেকে আলাদা করার চেষ্টা হচ্ছে, তারাই কিন্তু মোদি জামানায় এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে সবথেকে অত্যাচারিত, সব থেকে বঞ্চিত। তথাকথিত পসম¨া মুসলিমদেরই সবথেকে বেশি ঘরবাড়ি ভেঙেছে বিজেপির বুলডোজার রাজ। আর তাদেরই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য যে স্কলারশিপ ছিল, শিক্ষায় উন্নয়নের জন্য যে মাওলানা আজাদ ফাউন্ডেশন ছিল, বিজেপি সেগুলিকেও বন্ধ করে দিয়েছে। তাই মুসলিমদের মধ্যে বিজেপির আশার কিরণ মহিলা ও পসম¨া-রা গেরুয়া বাহিনীর ফাঁদে পা দেবেন বলে আদৌ মনে হয় না।
মোদিজি সন্দেশখালিতে নির্বাচনে এখনও একটি বড় ইস্যু করে তুলতে চাইছেন। বলছেন, কেন তৃণমূল, জাতীয় কংগ্রেস, এসপি বা অন্য দলগুলি দেখতে পাচ্ছে না? এ নিয়ে কথা বলছে না? এটা কিন্তু ঠিক কথা। তারা খুব বেশি কথা বলছে না। কারণ, অনেকে বলছেন, ইডির উপর হামলার পর সন্দেশখালিতে সমস্যা ও ব্যাপক নারী নির্যাতন ‘ম্যানুফ্যাকচার’ করা হয়েছিল। তাই হয়তো বিরোধী দলগুলি এ নিয়ে খুব বেশি কথা বলেনি। যেমনটি মণিপুরে সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের উপর ব্যাপক অত্যাচার হওয়া সত্ত্বেও মোদিজি মুখ খোলেননি।
মুখে কুলুপ এঁটে বলেছিলেন বিজেপির অন্য নেতারাও। পার্থক্য শুধু এই, মণিপুর ছিল প্রকৃতই হত্যা, নারী নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞ, চার্চ পোড়ানো ও জাতি সাফাই অভিযানের রমরমা দৃষ্টান্ত। এখনও মণিপুরে হাজার হাজার গৃহচ্যুত খ্রিস্টান আদিবাসীরা কথাকথিত উদ্বাস্তু শিবিরে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদিজি এখনও মুখ খোলেননি। বরং ‘মেইতেই জঙ্গিদের’ সরকারি সমর্থন রয়েছে বলে কুকি নেতারা জানিয়েছেন। শেষ কথা শুধু বলব, না মোদিজি না, স¨েশখালি আর মণিপুর মোটেই এক নয়। আপনি বরং মণিপুর নিয়ে একটু ভাবুন।