পুবের কলম প্রতিবেদক: কলকাতায় বাঙালি মুসলিমদের সাংস্কৃতিক উপস্থিতি খুব কম, এমন অভিযোগ ওঠে মাঝেমধ্যেই। সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে নানাজন নানাভাবে চেষ্টা করছেন। ‘পুবের কলম’ ও সাংস্কৃতিক মঞ্চ ‘একটি কুসুম’ এই ধারাতেই বিগত কয়েক বছর যাবত পার্ক সার্কাস ময়দানে একটি বাঙালি ঐতিহ্যসম্পন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হল না। বাংলা গানে-কবিতায়-কথায় গ্রাম-বাংলার মাটির ঘ্রাণ উঠে এল রবিবারের সন্ধ্যায়।
আল্লামা ইকবালের ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’ থেকে কাজী নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, রবীন্দ্রনাথ থেকে জয় গোস্বামীর কবিতা, নৃত্য থেকে আবৃত্তি—বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আর আধুনিকতার মিশেলে কালিম্পং থেকে কাকদ্বীপ মিলে গেল পার্ক সার্কাস ময়দানের মিলন উৎসবে। পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের উদ্যোগে প্রতি বছরই আয়োজিত হয় এই মিলন উৎসব। সেই উৎসবের মঞ্চেই উঠে এল বাঙালি সংস্কৃতির এক ঝলক।
দর্শকপূর্ণ সভায় ‘পুবের কলম’-এর সম্পাদক ও এই অনুষ্ঠানের আয়োজক আহমদ হাসান ইমরান যখন স্বাগত ভাষণ দিতে উঠছেন, তখন একটি একটি করে ভরে উঠেছে দর্শক আসনগুলি। মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান ও ‘পুবের কলম’ সম্পাদক ইমরান জানালেন, মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম পার্সি, জৈন, খ্রিস্টান, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ ধর্মের মানুষদের নিয়ে কল্যাণমুখী নানা কাজ করছে। তাদের তৈরি বিভিন্ন পণ্যকে সকলের সামনে নিয়ে আসছে এই উৎসবের মাধ্যমে। পাশাপাশি সকল সংখ্যালঘুদের জন্যই মাইনোরিটি কমিশন ও বিত্ত নিগম কাজ করে চলেছে। সম্প্রীতি ও মিলনের বার্তা দেয় এই উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিজস্ব কুটির শিল্প, খাবারদাবার ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে এই মিলনমেলায়।
এদিনের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন খাদিজাতুল কুবরা গার্লস মিশনের সভাপতি ও বিশিষ্ট উদ্যোগপতি, সমাজসেবী সামিনা মল্লিক। আহমদ হাসান ইমরান জানান, নারী শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন এবং দরিদ্র মানুষের জন্য নিরলস কাজ করে চলেছেন মুহতারমা সামিনা মল্লিক। তিনি দাওয়াহর জন্যও কাজ করছেন। তিনি একজন বড় উদ্যোগপতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাবিদও। ব্যবসাসূত্রে তিনি একজন আন্তর্জাতিক মানুষ। তাঁকে আমাদের মাঝে প্রধান অতিথি হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত।
এছাড়াও এই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিত্ত নিগমের চেয়ারম্যান পিবি সালিম, আইএএস শাকিল আহমেদ, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিßT্রার নুরুস সালাম, শাহিদ আকবর, কুতুবউদ্দিন তরফদার, তৃণমূল নেতা এ কে এম ফারহাদ, আরফান আলি বিশ্বাস, মুস্তাফিজ হাশমি, আলহাজ শিহাব চত্তুর, মাওলানা হুসেইন নুরানী, আবদুস সামাদ প্রমুখ।
এদিনের অনুষ্ঠানের মূল আয়োজন ছিল কবিতা, গান, নৃত্য। বিষয়-বৈচিত্র উপস্থিত দর্শকদের মন কেড়েছে। সোমঋতা মল্লিক ও তার দল ‘ছায়ানট’-এর পরিবেশনায় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ যেমন দশর্কমনে দোলা দিয়ে গেছে তেমনই সোমঋতার গলায় কাজী নজরুলের ‘জারিন হরফে লেখা আসমানি কোরআন’ পবিত্র গাম্ভীর্যে আচ্ছন্ন করেছে মানুষের মন। পানাগড়ের মামূন ন্যাশনাল স্কুল ও ডোমজুড়ের তাওহীদ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কচিকাঁচাদের নৃত্যগীত পরিবেশন মন জয় করে নিয়েছে। আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শালীন ও পরিশীলিত সংßৃñতির চর্চা কীভাবে করতে হবে, তার যেন জলজ্যান্ত উদাহরণ তারা। ছাত্রী নাজিয়া সুলতানা, তাসনিম নারগিস, নওশীনদের নৃত্য, আবৃত্তি, নাত সমাজের আলো-অন্ধকারগুলি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল।
‘সারে জাহাঁসে আচ্ছা’র তালে তাওহীদ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পড়ুয়াদের অপূর্ব নৃত্য পরিবেশনা আরও একবার দেশের প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল দর্শকদের। অনেকেই আবেগবিহ্বল হয়ে এই গানের সময় দাঁড়িয়ে পড়েন। কেউ কেউ মোবাইল বের করে ভিডিয়ো করতে শুরু করেন। মহাকবি ইকবালের গানের বার্তা ছুঁয়ে যায় সকলের অন্তরকে। এছাড়াও সংগীত পরিবেশন করেন জুলেখা সুলতানা। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ফারুক আহমেদ জানান, সম্প্রতি প্রয়াত সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব আবদুর রব খানের নাতনি জুলেখা সুলতানা।
এছাড়াও কবিতায় পিনাকী চট্টোপাধ্যায়, আরফিনা, লিটন রাকিব, ফারিহা সুলতানা, মুজিবর রহমান, শিফা পারভিন, এস কে সাইফুদ্দিন প্রমুখ নজর কেড়েছেন। বিশ্ব-সমাজের বৈচিত্র থেকে বর্তমানের দ্রোহ ফুটে উঠেছে তাদের আবৃত্তি করা কবিতাগুলিতে।
এই পশ্চিমবাংলা যে মহামিলনের মাঝে বৈচিত্রের বসতবাড়ি তা ফের এদিন ফুটে উঠল পুবের কলম-এর এই অনুষ্ঠানে। বারাসত নজরুল চর্চা কেন্দ্রের ড. সীমা রায় আবৃত্তি করলেন ‘ক্ষমা করো হজরত’। মানুষ যখন মেকি হয়ে উঠছে ক্রমশ, সাম্প্রদায়িকতার মুখোশ খুলে পড়ছে, বাড়ছে বিভেদ হানাহানি, তখন নজরুলের এই কবিতার পাঠ চেতনার গভীরে গিয়ে নাড়া দেয়। দর্শক আসনে উপস্থিত পার্ক সার্কাসের এক মহিলা জানালেন, বাংলা একটু একটু বুঝি। বুঝতে পারছি কাজী নজরুল সাহেবের এই কবিতায় কত মূল্যবান কথা বলা হয়েছে। তিনি আরও বললেন, আমি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-ইকবাল সবাইকেই পড়েছি। তাদের শিক্ষাই আরও বেশি বেশি দরকার বর্তমান সময়ে।
এদিনের অনুষ্ঠান চলাকালীন মঞ্চে উপস্থিত হন কেরল থেকে পায়ে হেঁটে মক্কায় হজ করতে যাওয়া ব্যক্তি—আলহাজ শিহাব চত্তুর। কেরল থেকে ভারতের রাজ্যগুলি পেরিয়ে, পাকিস্তান, ইরান ইত্যাদি দেশ পেরিয়ে হজে যাওয়ার সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতা তিনি দর্শকদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। তাকে দেখার জন্য মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাপক ভিড় জমে যায় মঞ্চের সামনে।
এদিন বিত্ত নিগমের পক্ষ থেকে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হককে নিয়ে ড. রামিজ রাজার একটি বই প্রকাশিত হয়। মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান জানান, ফজলুল হক কলকাতার মেয়র ছিলেন। হয়েছিলেন যুক্তবাংলার প্রথম প্রিমিয়ার। তার জন্মের ১৫০ বছর কেটে যাচ্ছে অগোচরেই। সেজন্য আমি উদ্যোগ নিই এবং রামিজকে ফজলুল হককে নিয়ে লিখতে বলি।
এই অনুষ্ঠান নিয়ে যে কথাটি বারবার বলতে হয় সেটা হল— বাঙালি সংখ্যালঘুদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে সমগ্র অনুষ্ঠানে। সেজন্য কলকাতার অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে এই অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যাপক সাড়া লক্ষ করা যায়। একদম শেষ লগ্নে কাজী নজরুল পরিবারের সদস্য সংগীত শিল্পী নূপুর কাজী যখন ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শেষ করলেন তখন দর্শকাসন থেকে ফের অনুরোধ এলো গান গাওয়ার। সময় শেষ।
নূপুর কাজী ‘দূর দ্বীপবাসিনী চিনি তোমারে চিনি’র মূর্ছনায় শেষের ঘণ্টাধ্বনি বাজাচ্ছিলেন মনোরম সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাটির, তখন যেন বাঙালি-অবাঙালি, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু আর দূরের মানুষ হয়ে থাকেনি। সুরের আবহে সবাই তখন একই দ্বীপের ‘কাছের মানুষ’।