হিমাদ্রিশেখর দে: হাওড়া জোনাকির উদ্যোগে , বিশ্বজিত দাসের নেতৃত্বে এক অভিনব প্রদর্শণী হয়ে গেল কালীবাবুর মাছবাজারে। এক অন্য ধারা শিল্পী হলেন হিরণ মিত্র। বর্ষীয়ান এই শিল্পী চেনা বৃত্তের বাইরে গিয়েও সমানভাবে জনপ্রিয়। তাঁরই প্রদর্শনী জুড়ে ঝুলছিল লাল,কালো,সাদা জীবনের সহ দাগ ক্যানভাসগুলি ,যা দাঁড়িপাল্লা থেকে হিমায়ক বরফ, হাড়ের স্কেলেটনের ফাঁক দিয়ে উঁকি মার ছিল দর্শকের চোখে।
দশ ফুটের আশেপাশের সমস্ত স্ক্রলে ছিল এক অন্তর্ভেদী, ইমপালসিভ ব্রাশ স্ট্রোকস,এক বৃত্তের নিহারিকাপুঞ্জে অনন্ত ছোটা যেন, আবার কখনো আরতে হাকরে থাকা আঁশ বটির ধারালো চকচক থেকে অকৃত্রিম আলো ছিটকে যাচ্ছে তড়িৎ গতিতে ঝুলন্ত ক্যানভাসের দিকে। শ্রীমিত্রের নিজের ক্যানভাস নিয়ে কোনো সংক্রামক ব্যাধি বা ছ্যুৎমার্গ নেই, বরং আশু উত্তেজনা তাকে নাছোড় করেছে এমন তর মনেপ্রানে প্রত্যাশিত কিছুর জন্যই।অবশেষে আজ অভূতপূর্ব এই উদ্যোগের জন্যই তা সম্ভব হল অনায়াসে।
ব্যাবসায়ী সমিতির সহযোগ, জোনাকির সকলের শ্রম আর ঢল নামা সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে যা পূর্ণ স্বার্থক। তাদের বিষ্ময়, ভালবাসায় ভেসেছেন শিল্পী ও সহযোগিরা সকলেই। বিশ্বজিত বলেছেন, এই আয়জন শ্রীমিত্রকে নিয়ে হতে পারে এ বিষয়ে তিনি আশাবাদী ছিলেন, এবং এই কাজ করতে সহজ ও শক্ত হৃদয় লাগে, শ্রীমিত্রই এই অন্তর্ঘাতের লক্ষ্য বস্তু। যে শিল্পী হৃদয়ের টানে মাছ কারবারিদের হাটে বসে প্রদর্শনীর ফাঁকে এঁকে ছেন অজস্র ছবি, মুহুর্ত কথা।
মানুষের এমন নিত্য দরবারে ছবির আর্তনাদ, যেন ভবিষ্যতের জন্য একটা দীগন্ত খুলে দিল, এখন যারা নাক শিঁটকোবেন বা গেল গেল করবেন, তারা যে কারনে রিলের দুনিয়ায় সংকটে পড়েছেন, তাদের সদগতি ঠেকানো এদের দায় নয়, কেননা এভাবেই শুরু হয় অঘোষিত কক্ষ পথ নতুন সম্ভবনায়, এখনই সময় নির্দ্বিধায় নেমে আসুন আপনাদের ঘোষিত – অঘোষিত সমস্ত শিল্প ভাবনা দিয়ে, কে বলতে পারে রোবোটিক্স যদি আমাদের ভবিতব্য হয়, এআই যদি নিদান হয়, যদি আপনার ক্লোন তৈরি হয় অদূর ভবিষ্যে সেই জটিল কক্ষের বিপ্রতীপে আপনারা চাইবেন না, আর একটি কক্ষপথ, নিজেদের, মুক্ত, বিহঙ্গের মতো যে চির স্বভঙ্গিমাময় এক স্বাধীন উড়ান।
শিল্পকর্ম শুধু স্টুডি ওর ঠান্ডা কক্ষই দাবী করেনা, সে দাবী করে একটা দ্বন্দ্বের ভিতর থেকেই ভালবাসতে। জীবনেরমতো, সে আকাশ থেকে পড়া আলপটকা ফাটকা বাজি নয়, এভাবেই তা মাছ বাজারকে বদলে দিতে পারে, দুজনেই, দুটো ক্ষেত্রেই সে যৌথতার কথপোকথন শুরু করতে পারে। সম্পূর্ণ শান্তি বলে কিছু নেই, বরং গ্যালারির অসূয়ার উল্টোদিকে এ যেন এক স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনাই বটে। কোনো সম্ভবনাকে গায়ের জোরে খাটিয়ে বন্ধ না করে বরং এলাউ করা উচিত। দেখা যাবে স্বপ্নাতীত স্বপ্নের সাহস ও উত্তেজনা।
ধন্যবাদ হাওড়া জোনাকিকে এমন এড্রেনালিন ক্ষরণের ব্যবস্থা করার জন্য। মানুষের দরবারে খুলে যাওয়া এ সংলাপ যাতে বন্ধ না হয় কোনো বিপন্নতায়। আগত সকল দর্শক এবং বিশেষ ভাবে হাওড়াবাসীদের অকুন্ঠ কৃতজ্ঞতা, বাহ্যিক আরম্বরের বাইরে ঘটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী থাকার জন্য। হিরণ মিত্রের এই একক প্রদর্শনীর পর এর পুণপরিবেশনার আকাঙ্খা যেন দৃঢ়তর হয়েছে সকলের মধ্যে।
ছবির জগতকে এমন টান মারার ঘটনা বিরল, এভাবে হয়তো প্রথম এক নিদর্শন তৈরি হলো হাওড়া জোনাকির তত্ত্বাবধানে। মাছ ব্যাপারীরা ইনস্টিটিউটে ব্যবহৃত পোষ্টমর্ডান, কিউবিজম, দাদাইজম, ইম্প্রেশনিজম শব্দগুলির অভিপ্রায় কিছুই জানে না, বেশি জানলে সিংহাসনে স্থবির বসে থাকতে হয়, বিবিধ প্রত্যাশায়, পুরুষ্কারের অছিলায়। আসলে গলিত আবর্জনার ভিতর মহলে ঢুকলে যেখানে অনেকে নাক চেপে ঢোকেন, তেমন একটি আপাত আঁশটে গন্ধের স্পেসকে মুক্ত শ্বাসের অকস্মাৎ রাস্তা বানানোর স্পর্ধার তাই তারিফ করতেই হয়, স্ট্রীটআর্ট এক্সিবিশন পৃথিবীর বিভিন্ন শহর, দিল্লী, মুম্বাইতেও দেখা যায়, কিন্তু কিলবিল করা মাছের পাখসাটে ছবি গুলির সহাবস্থান হয়ে উঠছিল একটা এক্সটেনশন অব ডায়ালগ, এক প্রসারিত করতলে কেউ কাউকে জানে না, দেখেনি কস্মিনে, কথা বলেনি দুদণ্ড, দুজনের স্থান ও সংসার ভিন্ন গোলার্ধে, আলোছায়ারা ভিন্ন পথগামী, তবুও বরং চাইলেই দোসরপনায় যে সত প্রচেষ্টার থেকে উদ্ভূত উদ্যোগে এমন শিল্পবান্ধব প্রদর্শনী ‘আর্ট ফর এভ্রি ওয়ান’ সফল করা যায়, তা চোখে না দেখলে অবিশ্বাস্য।
সমাজ চেতনার যে মুকুরে অবগাহন করলে অনুমেয় সাধ্যাতীত ঘটনাও শুধু রটনা নয় সব অর্থেই প্রানোজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার জন্য বিশ্বজিত দাসের যোগ্য নেতৃত্বে জোনাকির প্রচেষ্টাকে অভিবাদন, হিরণ মিত্রের মতোন একজন নীরব রেখাচিত্রকরকে এভাবে জানতে পারায় নিঃসন্দেহে সাধারণ দর্শকের মতো স্বয়ং শ্রীমিত্র অভিভূত।
বিদেশে ও দেশের বিভিন্ন স্টুডি ওগ্যালিরিতে শ্রীমিত্রের প্রদর্শনী হয়েছে ষাটের দশক থেকে কিন্তু তিনি গ্যালারি থেকে বারবার নিজেকে টান মেরেছেন, কখনো বেনারসের গঙ্গার ঘাটে, জাপানে ভিস্যুভিয়াসের সিরিজ স্টাডিতে, জঙ্গলের ভিতর, টেরাকোটা,পটচিত্রের ভাবনায়, নাট্যমঞ্চে, প্রচ্ছদনির্মাণের, সংশয়াতীত অনুসন্ধানের মধ্যেই সে পরিক্রমায় তিনি হেঁটেছেন বিস্তর , আর এই বিস্তার যেন নির্বিবাদ বহুমূল্যের হয়ে উঠেছে কালীবাবুর বাজারের এই অনন্য প্রদর্শনীতে।