পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক : মন্ত্রোচারণের মাধ্যমে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে সাত পাক ঘুরে সাত জনমের সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই দৃঢ় বন্ধনে ভাঙন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। কারণ যাই হোক কেন গত ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত চার বছরে রাজ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে ১৪ হাজার ৫০৯ দম্পতির। চলতি বছরের ৬ মাস পর্যন্ত ধরলে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ২৮৯-এ।
রাজ্য আইন দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৯২ হাজার ৯৪৮ জুটি বিবাহ সম্পর্কে আবদ্ধ হন এবং ওই বছর ১ হাজার ৯৯৭টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। পরের বছর ২০২০-তে ১ লক্ষ ৪৯ হাজার ৭১৮ জন যুগলের বিবাহ হয় এবং ৩ হাজার ৩৬জন দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। করোনা মহামারির মধ্যেও বিয়ের সংখ্যায় বৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো ছিল। ওই বছর ১ লক্ষ ৮৮ হাজার ৮১৪ যুগলের চার হাত এক হয়েছিল। বিবাহের সংখ্যা যেমন বেড়েছিল, তেমননি বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যাতেই বৃদ্ধি হয়েছিল। বিচ্ছেদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩৫১। অন্যদিকে, গত বছরে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা ৫ হাজার ১২৫-এ পৌঁছে যায়। গত বছরে ১ লক্ষ ৮২ হাজার ৭৪ যুগলের চার হাত এক হয়েছিল। এছাড়া, চলতি বছরের ৬ মাসে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে ৩ হাজার ৭৮০ দম্পতির এবং ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৪৪৬ জুটি বিবাহের সম্পর্কে আবদ্ধ হন। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, এ বছর রাজ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা রেকর্ড গড়তে পারে।
বিবাহ বিচ্ছেদের এই ক্রমবর্ধমান সংখ্যা নিয়ে বিচলিত হওয়ার কোও কারণ নেই বলে মনে করছেন মনস্তত্ত্ববিদ অভিরুচি চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, আগেও বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটত। তবে সে সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল। কারণ, আগে মহিলারা আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী ছিলেন না। তাই সব কিছু ছেড়েছুড়ে বাপের বাড়ি ফিরে যেতে পারতেন না। বাপের বাড়ি ফিরে গেলে তাঁদের লজ্জা, অপমান, লাঞ্ছনার শিকার হতে হত। সেজন্যই শ্বশুরবাড়িতে তাঁরা সবকিছু সহ্য করে মুখ বুজে থাকতেন এবং দাম্পত্য জীবনকে যেকোনও মূল্যে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। বিচ্ছেদের কথা তাঁরা ভাবতেও পারতেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন মহিলারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। এখন তাঁরা অনেক বেশি স্বাধীনচেতা। তাই জোর করে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে রাজি নন তাঁরা। বিষিয়ে যাওয়া সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাওয়ার থেকে বিচ্ছেদ হয়ে গেলে দু’টি মানুষই মুক্ত হতে পারেন। যে যার পছন্দমতো জীবন বেছে নিতে পারে। এছাড়াও তাঁদের বিষিয়ে যাওয়া সম্পর্ক তাঁদের সন্তানদের জীবনকেও বিষিয়ে দিতে পারে।
তাই সেই সম্পর্ককে সম্মানজনকভাবে শেষ করে দেওয়ায় ঠিক বলে মনে করেন অনেক দম্পতিই। দিন বদলেছে, এখন তো দেখা যায় বিচ্ছেদের পরও তাঁরা নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখেন। এমনকি বিচ্ছেদের বর্ষপূর্তিও পালন করতে দেখা যায় অনেককে। বিচ্ছেদের অনেকগুলি পজিটিভ দিকও আছে।
তবে সমাজতত্ত্ববিদ দেবদ্যুতি কর্মকার মনে করেন, শুধুমাত্র মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতার কারণেই বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েছে এমনটা নয়। এখন পুরুষ-মহিলা উভয়েই আত্মনির্ভর, তাই জটিলতা থাকলে কেউ আজীবন সেই সম্পর্ককে বয়ে বেড়ানোর পক্ষপাতী নন। করোনার পর এই মানসিকতা খুবই বেড়েছে। তাছাড়া সুস্মিতা সেন বা করণ জোহরের মতো সেলিব্রিটিরা সিঙ্গল ফাদার বা সিঙ্গল মাদার-এর মতো ধারণায় অনেকেই প্রভাবিত হচ্ছেন এবং একা থাকার ক্ষেত্রে ভরসাও পাচ্ছেন।