জঙ্গলের মাথায় হেলিকপ্টার l জিপিএস বলছে এইখানেই। প্যারাসুটে নামল শ্যুটারl নিখুঁত শ্যুটl ফটো ফিনিশ l ট্রাঙ্ককুলাইজার ডার্ট অতি উন্নত স্বয়ংক্রিয় l চেইন করাতে সন্তর্পণে নিমেষে কেটে নেওয়া হল খড়্গl হেলিকপ্টার দ্রুত ওড়ে আকাশে l এ চিত্রনাট্য বড়জোর ৭-১০ মিনিটেরl জঙ্গলের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্তন্যপায়ী গণ্ডার খড়্গহীন হল l সবুজ জঙ্গল রক্তে রঙিনl আমাদের “গণ্ডারের চামড়া”l আঁচ লাগল না মনুষ্যত্বেl গভীর বেদনার কথা তুলে ধরেছেন ড. শুভময় দাস।
আজ বিপন্ন পৃথিবীতে ২২ সেপ্টেম্বর, ‘বিশ্ব গণ্ডার দিবস’। ২০১১ সালে ‘ডাব্লুডাব্লুএফ'(ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার)-এর উদ্যোগে গণ্ডার বাঁচাও কর্মসূচির দশমবার্ষিকীl তবুও বিশ্ব হারাবে হারাধনের ‘বড় পাঁচ’কে। সারাবিশ্বে পাঁচটা প্রজাতির গণ্ডার বেঁচেl জাভা, সুমাত্রা, কালো, সাদা আর ভারতীয় একশৃঙ্গl আফ্রিকায় অন্তত তিনটে গণ্ডার খুন হচ্ছে কোথাও না কোথাও প্রতিদিন, বছরে অন্তত দেড়হাজারl “পাঁচ ভাইয়া” প্রজাতির সংখ্যা নিভু নিভুl একটা দমকা হাওয়ায় দপ করে জ্বলে উঠে, চিরতরে নিভে যাওয়া, শুধু সময়ের অপেক্ষাl গণ্ডার পৃথিবীতে টিকে আছে কেবল আফ্রিকা আর দক্ষিণ এশিয়ায়।
সারা বিশ্বে জাভা গণ্ডার হাতের গাঁট গুণেগুণে মাত্র ৭০, সুমাত্রীয় ১০০টি, ব্ল্যাক ৫০০০টি, হোওয়াইট ১৭০০০টি আর ভারতীয় একশৃঙ্গ ৩৫০০টিl এশিয়ায় মেলে জাভা, সুমাত্রা ও একশৃঙ্গl আফ্রিকায় কালো ও সাদা গণ্ডারl
এশিয় গণ্ডারের অবস্থা বড্ড করুণ! মাত্র আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকবে জাভা, আর সুমাত্রার গণ্ডার। ওরা ক্রিটিক্যালি এনডেঞ্জারডl সাদা-ওদের ভালো অবস্থা আসন্ন বিপদমুক্তl ভারতীয় একশৃঙ্গ ওরা ভালনারেবলl
তা মাথায় ওরম খড়্গ কেন বাপু? খড়্গ না থাকলে তো মানুষ খড়গহস্ত হতই না! মানুষের লোভ চাগিয়ে উঠত নাl মিথ তৈরি হত নাl ক্যান্সার পুরুষত্বহীনতা মৃগী রোগের ওষুধের মিথ্যা সংস্কার তৈরি হত নাl মরতে হত নাl ঘাসপাতা খাওয়া নিরীহ বিশাল বপুরা আজ বিপদেl সাদারা ওজনে ৩৫০০ কেজিl শরীর বড় হলে কি হবে বাপু-মগজে বুদ্ধিশুদ্ধি তো কিছুই নেই! মগজ মাত্র ৫০০ গ্রামের! বুদ্ধিশ্রেষ্ঠ (!) মানুষ তো মাথা উড়িয়ে দেবেই!
স্ত্রী গণ্ডারেরা মিষ্টি স্বভাবের ও সামাজিকl পুরুষরা একা এবং একা কিন্তু কর্তা এলাকা রক্ষায় সচেতনl বিশাল বপুl চোখের দৃষ্টি ক্ষীণl স্থিরবস্তু দেখতেই পায় নাl ৩০ মিটার দূরের স্থিরবস্তু একেবারেই দেখতে পায় নাl এগুলোই চোরা শিকারিদের মূলধন। তারা জানে কখন কোথায় একটি গণ্ডার নির্দিষ্ট স্থানে মলত্যাগ করতে বা চান করতে আসবেl তারা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে রেডি।
গত ১০ বছরে শুধু আফ্রিকায় ৭৫০০ গণ্ডার লাশ হয়েছে চোরা খড়্গকারবারির স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে আর করাতের ধারালো ফলায়। দিনে ৩টি লাশ আফ্রিকায়l ভারতে বছরে গড়ে ২৫টাl এ তো বাহ্যিক। প্রকৃত তথ্য ভয়ানকl এক সময় পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন গোসাবায় গণ্ডার দাপিয়ে বেড়াতl আজ সরে যেতে যেতে অসম কোচবিহারে ওরা কোণঠাসা। আর মাত্র কয়েকটা সকাল তারপর ‘বিগ ফাইভ’ পৃথিবী থেকে টাটা বাই বাই করবেl আমরা শুধু বসে বসে দেখবl
ওরা নির্বিবাদী আর শান্ত স্বভাবেরl তাই যা খুশি করা যায়! সংখ্যাহ্রাসের কারণ সেই একই, বাসস্থান নষ্ট, আবহাওয়া পরিবর্তন, চোরাশিকার, কুসংস্কার আর মানুষের অনন্ত লোভl ক্ষুরধার বুদ্ধি নিয়ে খড়গহস্ত হয়ে খড়্গ কেটে নেওয়ার নেশায় মত্ত আমরাl ধনী-দরিদ্র সবাই যৌনতার গন্ধমাখা রাসায়নিক খুঁজিl রসায়ন লাভে যত ব্যর্থ হই তত রোখ চেপে বসেl কোপের পর কোপ বসে নাক- খড়্গ- মাথায়l আন্তর্জাতিক বাজারে খর্গের দাম সোনার চেয়েও বেশিl অথচ রসায়নে নখের সমতুল। বাহারি নাকের জন্য বারবার ওদের প্রাণ জেরবার। জীবনভর বেড়ে চলা নাসাখর্গের নাগপাশে ওদের মৃত্যুর মন্ত্র লেখা হয় প্রতিদিনl
এখন প্রশ্ন কি করণীয়? একটাই কথা, সচেতনতা, কঠোর আইন আর কুসংস্কার হঠানোl ২০১৯- এ ভারতের পরিবেশ ও বনমন্ত্রক ওদের বাসস্থান সংরক্ষণে গুরুত্ব দিয়েছেনl ওদের খাবার ও লুকিয়ে থাকার জন্য নির্দিষ্ট প্রজাতির লম্বা ঘাসের চাষ করে বাসস্থান পুনরুদ্ধার করা, সুরক্ষা জোরদার করা, বাসস্থানের বিস্তৃতি ঘটানো, গবেষণা ও তদারকির কাজ বাড়িয়ে তোলা আর এদের সুরক্ষায় অর্থলগ্নি করে আশার আলো দেখতে পারিl এখন সচেতনতা ও সুবুদ্ধিই ভরসাl