আহমদ হাসান ইমরান: গাজায় ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি যে নৃশংস, বর্বর জেনোসাইড চালাচ্ছে তা এখন সারা দুনিয়ার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন সরবরাহ করছে অর্থ এবং অস্ত্র। তারা ইসরাইলকে দিচ্ছে এফ-১৫ জাতীয় যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা এবং অন্যান্য মারণাস্ত্র। এছাড়া এই রাষ্ট্রগুলি ইসরাইলকে সমস্ত ধরনের গোয়েন্দা তথ্য প্রদান করছে।
প্রথমে পরিকল্পনা ছিল যে, ইসরাইল ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই ধ্বংস ও জাতি সাফাই অভিযানের দ্বারা গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে এবং হামাস, আলফাতাহ প্রভৃতি স্বাধীনতাকামী নেতৃত্ব এবং সংগঠনকে সম্পূর্ণ নিকেশ করে দেবে। হামাসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তারা ভুলে যায়, হামাস অবরুদ্ধ গাজা জনপদে নির্বাচনে জিতেই ক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু সবথেকে বড় হত্যাকারী সন্ত্রাসী দেশ ইসরাইলকে তারা মনে করে গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র হিসেবে! যদিও ইসরাইলের গণহত্যার ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে।
সে সব কথা থাক। ইসরাইল গাজার সমস্ত পরিকাঠামো, ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ কেন্দ্র সবই ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের আক্রমণে নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ৩৫,০০০-এ। আহতের সংখ্যা প্রায় ৮০,০০০। সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না, এমন সংখ্যা ১৫,০০০-এরও বেশি।
কিন্তু সারা দুনিয়াকে হতবাক করে হামাস এবং গাজার অধিবাসী ফিলিস্তিনিরা দেখিয়ে দিয়েছে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মারণাস্ত্রগুলি ব্যবহার করেও এই ছোট্ট জনপদকে পরাজিত করা যায়নি। হামাস আজও গাজায় তাদের কর্তৃত্ব অব্যাহত রেখেছে এবং তারা সমানতালে ‘অপরাজেয়’ বিশ্ব-শ্রেষ্ঠ ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। ইসরাইলের হাসপাতালগুলি আহত ও মুর্মূষু সৈন্যদের দ্বারা ভরে গেছে। কাজেই ফিলিস্তিনকে নিয়ে ইসরাইল ও পশ্চিমাদের যে বহু স্বাধের পরিকল্পনা ছিল, তা সম্পূর্ণ ভেস্তে গেছে। এর পিছনে রয়েছে হামাস ও ফিলিস্তিনবাসীদের ঈমানী শক্তি, কুরবানি, অদম্য সাহস এবং সীমিত সমরাস্ত্র নিয়েও লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা। এছাড়া তাদের সমর্থনে সরাসরি মাঠে নেমেছে লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুথি আনসারুল্লাহ। আনসারুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণে লোহিত সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের বাণিজ্য এবং যুদ্ধজাহাজগুলি কার্যকর কোনও ভূমিকারাখতে পারছে না।
এই মুহূর্তের খবর হচ্ছে, অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইসরাইল একটি যুদ্ধ-বিরতি পরিকল্পনা হামাসের কাছে পেশ করেছে। এর পিছনে রয়েছে মিশর ও সউদি আরবেরও সমর্থন। এর দ্বারা প্রথমে ৪০দিনের যুদ্ধ বিরতি এবং ৩৩ জন করে ইসরাইলের যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, গাজায় মানবিক সাহায্য সেক্ষেত্রে ত্বরান্বিত করা হবে।
হামাস কিন্তু এবার প্রথম বলেছে, তারা প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখবে যে, এতে ফিলিস্তিনের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হয়েছে। তারা এখনও এই প্রস্তাবটিকে গ্রহণ, বর্জন বা সংশোধনের বিষয়ে কোনও কথা বলেনি।
ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধ-বিরতির পর দেখা হবে গাজায় যেন হামাসের নিয়ন্ত্রণ না থাকে। ভিন্ন কথায় ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্ব এবং সেইসঙ্গে সউদি আরবের রাজতন্ত্র এবং মিশরের সামরিক স্বৈরতন্ত্র চাইছে হামাস এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করুক। কারণ, তারা হামাসকেও প্রবল ভয় করে। তারা মনে করে হামাস যেকোনও সময় সউদি আরব ও মিশরের জনগণকে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের পতনের জন্য ব্যবহার করতে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। বিনিময়ে সউদি আরব এবং অন্য যেসব মুসলিম দেশ এখনও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি তারা যায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। তাহলে গাজা-সহ ফিলিস্তিন কারা শাসন করবে? পশ্চিমারা চায় হামাস-মুক্ত এক রাষ্ট্র। যেখানে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধাঁচে ভোট করে এক নরমপন্থী সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হবে। যেমন এক সময় আমেরিকা আফগানিস্তানে তাদের তাঁবেদার ও সমর্থক কিছু সরকারকে গদিতে বসিয়েছিল। কিন্তু আফগান জনগণ এইসব তাঁবেদার সরকারকে কখনই স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তারা লড়াই করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলিকে আফগানিস্তানের মাটি থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করেছে। কাজেই ইসরাইল ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলির প্ল্যান হচ্ছে, সম্ভাব্য ফিলিস্তিন সরকারের কিছু পুলিশ থাকতে পারে। কিন্তু কোনও সামরিক বাহিনী থাকবে না। এই দায়িত্ব পালন করবে আরব রাষ্ট্রগুলির সেনা সমন্বয়ে গঠিত এক সেনাবাহিনী।
বিকল্প হিসেবে চাপ সৃষ্টির জন্য নেতানিয়াহু বলে যাচ্ছেন, তাঁরা দু-একদিনের মধ্যেই রাফায় আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনের উপর আক্রমণ শানাবে। অর্থাৎ আর একটি জেনোসাইড করবে এবং গাজাবাসীদের রাফা সীমান্ত দিয়ে মিশরে নির্বাসিত করবে এবং সিনাই উপত্যকায় তাদের জন্য মরুশহর নির্মাণ করা হবে।
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, হামাস পশ্চিমাদের যুদ্ধ-বিরতি পরিকল্পনাকে মানে নেবে? না তারা আরও শর্ত জারি করবে?