আহমদ হাসান ইমরান: পবিত্র মাহে রমযান। শুধু ভারত নয়, সারা দুনিয়ার মুসলিমরা এই মাসটিকে খোশ আমদেদ জানানোর জন্য প্রতীক্ষায় থাকেন। কারণ, রমযান মাসে একইসঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকার প্রচেষ্টায়রত হওয়া এবং ইবাদত বা উপাসনার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও রহমত কামনা এবং সৃষ্টিকূলের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশের সুযোগ পাওয়া যায়। একমাস ব্যাপী সিয়াম পালন বা উপবাসের দ্বারা রোযাদাররা চেষ্টা করেন সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণের দ্বারা নাযাত বা মুক্তি অর্জনের সাধনা করার।
আর উল্লেখযোগ্য হল যে, দেশের অমুসলিম ভাইরাও মাসব্যাপী এই সাধনাকে খুবই প্রশংসার চোখে দেখে থাকেন। অনেকে আবার ইফতার করার দাওয়াতও দেন তাঁদের মুসলিম ভাইদের। ইফতার শেষে তাঁরাই উদ্যোগ নিয়ে নামাযের ব্যবস্থা করেন রোযাদারদের। একটিমাত্র উদাহরণ দেব, বহু কারাগারে হিন্দু কয়েদিরা তারা মুসলিম কয়দিদের সঙ্গে রোযা পালন করেন।
কিন্তু চিরায়ত ভারতবর্ষের এই ছবিটা ইদানিং পুরোপুরি পালটে যাচ্ছে। রমযান শুরু হয়েছে দিন ছয়েক হল। এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যা সমস্ত ধর্মপ্রাণ মানুষকে লজ্জিত ও ব্যথিত করবে।
প্রথমেই উল্লেখ করা যাক মহারাষ্ট্রের ঘটনাটি। মহারাষ্ট্রের এক মফঃস্বল এলাকায় একজন মধ্য বয়স্ক ইমাম জাকির সাইয়দ খাজা একাকী মসজিদে বসে কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর জিকির করছিলেন। কিছু সন্ত্রাসী মসজিদে ঢুকে ওই ইমামকে কোনও কারণ ছাড়াই হঠাৎই প্রচণ্ড মারধর করতে থাকে। পরে তাঁকে মসজিদ থেকে বের করে রাসায়নিক দিয়ে অজ্ঞান করে দেয় এবং ইমাম সাহেবের দাড়ি কেটে দেয়। ভাগ্যভালো এই সন্ত্রাসীরা তাঁকে হত্যা করেনি।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন মাহে রমযানে একজন ইমামের প্রতি এই আচরণ? তিনি তো ঈশ্বরের ইবাদত করছিলেন। তাতে কেন দুষ্কৃতীদের ক্রোধ? সমাজ কতটা বিষিয়ে গেলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে! এর প্রতিকার কোথায়?
একটু অন্যরকম কিন্তু একই ধরনের খবর এসেছে উত্তরপ্রদেশের ঐতিহ্যবাহী শহর নয়ডা ও মোরাদাবাদ থেকে। মাহে রমযানের তারাবিহর নামায পড়ছিলেন মোরাদাবাদের একটি এলাকায় কিছু মুসলিম। রাষ্ট্রীয় বজরং দলের হামলাকারীরা সেই তারাবিহর নামায পাঠকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। হুকুম জারি হয়, সেখানে আর মুসলিমরা নামায পড়তে পারবে না। একই কাণ্ড ঘটেছে নয়ডায়। একটি আবাসন এলাকায় মুসলিমরা খালি বেসমেন্টে ৩০-৪০ জন মুসল্লী নিয়ে তারাবিহর নামায আদায় করছিলেন। তাঁদেরও প্রতিবেশি হিন্দু ভাইরা বলে দেন, বেসমেন্টে প্রার্থনা করার কোনও অনুমতি তাঁদের নেই। পুলিশ আসে, মুসলিমরা মুচিলেখা দেয়, তাঁরা সেখানে নামায পড়ার চেষ্টা করবে না।
এই নামায পড়ায় কারও কোনও ক্ষতি হচ্ছিল না। মিনিট ৪০-এর এই নামাযের পরই মুসল্লীরা নিজ নিজ ঘরে চলে যান। কিন্তু মুসলিমদের এটাও করতে দিতে রাজি নয় তাদের প্রতিবেশি হিন্দু ভাইরা। অবশ্য পুলিশ জানিয়েছে, ‘নামায বাতিল হওয়ায় ওই এলাকায় এখন পুরোপুরি শান্তি বিরাজ করছে’। বাঙালি কবি হয়তো একেই বলেছিলেন ‘শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে’।
তাহলে মুসলিমরা এখন কি করবে? ভারতবর্ষে তাদের রয়েছে হাজার বছরেরও বেশি ইতিহাস, ঐতিহ্য। দেশের সবক্ষেত্রে তাদের সম-অবদান রয়েছে। এখন কম করে ২১ কোটি মুসলিম রয়েছেন ভারতবর্ষে। এদের বেশির ভাগই ভূমিপুত্র। স্থানীয়রা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছিলেন।
যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে এই ২১ কোটি বণি আদম কি নিজেদের নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার ছেড়ে দেবে? তাঁরা কি আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতারা যেমন চেয়েছিলেন, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে কোনও সমস্ত অধিকার বাদ দিয়ে কোনোভাবে এই হিন্দুস্তানে বসবাস করবেন? ২১ কোটির প্রতি এই ঘৃনা কিন্তু দেশের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য প্রবল বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। যারা ভারতের ক্ষতি চান, তাঁরাই বিদ্বেষের এই যোজনা তৈরি করেছেন। তবে আশার কথা, ভারতের এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ রয়েছেন, যারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন। এই সুশীল সমাজের এবার অবশ্যই এগিয়ে আসার সময় হয়েছে।