দেবশ্রী মজুমদার,শান্তিনিকেতন, আদালতের নির্দেশ লাগু না করে এবং কর্ম সমিতির অধিকারকে খর্ব করায় ফের ভৎর্সনার মুখে উপাচার্য এবং সেই সঙ্গে আরেকবার মুখ পুড়ল বিশ্বভারতীর। মঙ্গলবার আদালত আরও কড়া মনোভাব নিয়ে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট মেনে ও আদালতের রায় মেনে নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট।
মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক অমৃতা সিনহা বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনের মনিপুরী নাচের অধ্যাপিকা শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায় পি এইচ ডি, ডি লিট এর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রায় দিতে গিয়ে কার্যত বিশ্বভারতীর উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষকে তীব্র ভৎর্সনা করেন।
বশংবদ না হওয়ায় বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনের মনিপুরী নাচের অধ্যাপিকা শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈধ ছুটির আবেদনকে বিভিন্ন টালবাহানায় প্রভাব খাটিয়ে মঞ্জুর হতে বাধা দেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। উল্লেখ্য, গতবছর ২৮জুলাই বিশ্বভারতী কতৃপক্ষ উপাচার্যের নির্দেশে অধ্যাপিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাজে যোগ না দেওয়ার নির্দেশ দেন ও জুন ২০২০ থেকে তাঁর প্রাপ্য মাইনে আটকে রাখা হয়। অভিযোগ করা হয় যে অধ্যাপিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘যথাযথ’ কতৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে নিয়ে স্টেশন লিভ করেছেন, তাই এই সিদ্ধান্ত। যদিও শ্রুতি দেবী দাবী করেন সমস্ত প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়েই তিনি শান্তিনিকেতনের বাইরে গিয়েছিলেন। এই মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর অবিলম্বে শ্রুতি দেবীকে তাঁর প্রাপ্য সমস্ত টাকা দিয়ে দেবার নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। নানা টালবাহানা করার পর কোর্টে ধাঁতানি খেয়ে তাঁর সাত মাসের প্রাপ্য দিয়ে দিলেও তাঁকে কাজে যোগ দিতে দেওয়া হয় নি। এরপর কলকাতা হাইকোর্টে একটি আবেদনের মাধ্যমে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজে যোগ দেবার আবেদন জানান শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই মামলায় গত ১৫ জুলাই বিচারক অমৃতা সিনহা বিশ্বভারতীর কর্ম সমিতি (এক্সেকিউটিভ কাউন্সিল)কে নির্দেশ দেন শ্রুতি দেবীর গোটা মামলাটি শুনে অবিলম্বে একটি গ্রহনযোগ্য আইনানুগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। এবং তা আদালতকে জানাতে হবে। হাইকোর্টের এই নির্দেশ জানিয়ে গত ৩ আগস্ট শ্রুতিদেবীর আইনজীবী পুস্পল চক্রবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়কে এ বিষয়ে ইমেল মারফৎ সচেতন করেন। সেই দিনই শ্রুতিদেবীকে একটি চিঠি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মসচিব অশোক মাহাত জানান যে উপাচার্য নিজে এবং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কর্ম-সমিতির এক সদস্যকে নিয়োগ করেছেন। সূত্রের খবর তিনি তাঁর পরিচিত এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এস যাদবকে ১০ আগস্ট অধ্যাপিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পার্সোনাল হিয়ারিং’নেবার দায়িত্ব দিয়েছেন ।
শ্রুতি বন্দ্যোপাধায়ের আইনজীবী বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন এবং আদালত শুনানির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবীকে এব্যাপারে হাজির থাকার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ পেয়ে বিশ্বভারতী তাঁর পূর্বের বক্তব্য থেকে পুরোপুরি সরে গিয়ে বলে, উপাচার্য একজনকে বলেছেন হিয়ারিং নিয়ে কাউন্সিলের সদস্যদের জানাতে। এখানেই আদালত স্পষ্টত উপাচার্য ও কাউন্সিলের লক্ষ্মণ রেখা নির্দেশ করে বলেছে কর্ম সমিতির কোরাম বজায় রেখে শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য শুনতে হবে। এক্ষেত্রে পার্সোনাল হিয়ারিংয়ের অর্থ কর্ম সমিতির অধিকার খর্ব করা এবং আদালতের নির্দেশ লাগু না করার ঔধত্য দেখানো। বিশ্বভারতীর অ্যাক্ট ও স্ট্যাটুট অনুযায়ী উপাচার্য এরকম কোনো কাজ করতে পারেন না, যখন আদালত কর্ম সমিতিকে নিয়োগ করে দিয়েছে।
চিঠির জবাবে শ্রুতিদেবীর আইনজীবী তাদের এই ব্যাপারটি বেআইনি বলে উল্লেখ করে আবারও এক চিঠি দেন। গতকাল, ৯ আগস্ট বিশ্বভারতীর কর্মসচিব সেই চিঠির জবাবে আবারও একই বিষয় জানিয়ে বলেন যে যে উপাচার্য মহাশয় একজনকে নিয়োগ করেছেন, তিনি শ্রুতিদেবির ‘হিয়ারিং’ নেবেন এবং তার রিপোর্ট কর্ম সমিতিকে দেবেন।
মঙ্গলবার বিষয়টি আদালতের সামনে রাখেন শ্রুতি দেবীর আইনজীবী। আদালত সুত্রে খবর, বিচারপতি অমৃতা সিনহা এদিন শোনেন কিভাবে উপাচার্য তার নিজের অ্যাক্ট ও স্ট্যাটুট এবং কোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘন করেছেন। যদিও বিশ্বভারতীর আইনজীবী আদালতকে জানান যে পার্সোনাল হিয়ারিং রেকর্ড করে কর্ম সমিতির ১৯ জন সদস্যকেই দেওয়া হবে।
এরপরই বিচারপতি অমৃতা সিনহা বিশ্বভারতীর আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করেন যে উপাচার্য কোন ধারা অনুযায়ী এরকম ‘পার্সোনাল হিয়ারিং’ এর আয়োজন করেছেন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটুটে স্পষ্ট লেখা যে অন্তত ছয়জন সদস্যকে কর্ম-সমিতির মিটিঙে থাকতে হবে এবং তার চেয়েও বড়, যখন গত ১৫ জুলাই আদালত তার রায়ে স্পষ্ট বলে দিয়েছে যে কর্ম সমিতিই শ্রুতিদেবির গোটা ব্যাপারটা শুনবে।
বিশ্বভারতীর আইনজীবী কয়েকদিনের সময় চাইলে সেটা না মঞ্জুর করেন বিচারপতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী করোনা বিষয়টি উত্থাপন করলে বিচারপতি সিনহা ভার্চুয়াল মিটিঙের অনুমতি দেন। সেই সঙ্গে এদিন বিচারপতি অমৃতা সিনহা বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দেন তার নিজের আইন মেনে কাজ করতে এবং কর্ম সমিতিকে নির্দেশ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটুট অনুযায়ী শ্রতিদেবীর আবারও কাজে যোগ দেবার ব্যাপারটি দেখতে। তাদের মিটিং অনলাইনে করতে কোর্টের আপত্তি না থাকলেও স্ট্যাটুট অনুযায়ী তাদের কোরাম বাধ্যতামূলক ভাবে মেনে চলতে হবে।