রক্তিমা দাস : সবেমাত্র শুরু হয়েছিল অফলাইন ক্লাস। দীর্ঘদিন অনলাইন ক্লাসের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন পড়ুয়ারা। ২৪ ফেব্রয়ারী দিনটাও ছিল তেমন। সারাদিন ক্লাস করে পরের দিনের প্রস্তুতি নিয়ে সেদিনের মত দুচোখের পাতা এক করেছিলেন দেবমাল্য। কিন্তু হঠাৎ কি হল। ভোর হতেই আগেকার পুরনো চিত্রটাই বদলে গেল। চারিদিকে মৃত্যুর হাহাকার। ইউক্রেন হামলা করেছে রাশিয়া। পড়াশোনা ভবিষ্যৎ সব কিছু বাদ দিয়ে তখন শুধুই বাঁচার জন্য রাস্তায় নেমে পড়েছিল দেবমাল্যরা।
হিন্দমোটরের বাসিন্দা দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায়, ২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ২০২০ সালে ডাক্তারি পড়ার জন্য ইউক্রেন পাড়ি দিয়েছিলেন দেবমাল্য। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রয়ারী ভবিষ্যতের সবুজ স্বপ্ন আচমকাই যেন ধুসরে পরিণত হয়েছিল। দীর্ঘ চার দিনের পথ পেরিয়ে অবশেষে পয়লা মার্চ কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছায় দেবমাল্যরা। এই চার দিনের পথ মোটেও ততটা সহজ ছিল না।
দুর্র্ধষ সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, আমরা দুদিন ঘর থেকে বের হইনি। কি করবো, কোথায় যাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এরপর ২৭ ফেব্রয়ারী সব গুছিয়ে বেরিয়ে পরলাম বন্ধুরা মিলে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, যে করেই হোক বর্ডারে পৌঁছতে হবে। নিজেরাই গাড়ির আয়োজন করেছিলাম। বর্ডারে গিয়ে যখন পৌঁছলাম, সেখানে থিকথিকে ভিড়। বিভিন্ন জায়গা থেকে পড়ুয়ারা এসে উপস্থিত হয়েছেন। প্রত্যেকেই চাইছে আগে ফ্লাইট ধরতে। সেই সময় খোলা আকাশের মুহুর্মুহু ফায়ার করতে থাকে ইউক্রেন সেনারা। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসছিল। তখন খাবার, জল সব শেষ হয়ে এসেছিল। সেনাদের কাছ থেকে কোনো রকমের সাহায্য পাইনি আমরা। সেই সময় স্থানীয় বাসিন্দারাই আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই সময় প্রায় ১৮ ঘন্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়েছে আমাদের। অবশেষে আমারা ফ্লাইটে উঠতে পারি। এরপর ২৮ ফেব্রয়ারী আমরা পৌঁছালাম রোমানিয়া বর্ডারে।
কিন্তু রোমানিয়া বর্ডারে পৌঁছেও পরিস্থিতি কিছু বদলালো না দেবমাল্যদের। সেখানে গিয়ে সেন্টারে ঢুকতে পারলেও খাবারের কোন ব্যবস্থাই ছিল না। সেখানকার স্থানীয় রোমানীয় বাসিন্দারাই জন্য খাবারের আয়োজন করে। এরপর ছিল শুধুই দিল্লি ফ্লাইটের টিকিটের অপেক্ষা। অবশেষে ২ মার্চের টিকিট পাওয়া গেল। কিন্তু সেন্টার থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাওয়া হবে কি করে! সেখানেও স্থানীয় রোমানিয়রাই এগিয়ে এসেছিল দেবমাল্যদের সাহায্যার্থে। শেল্টার থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল তারাই। এরপর ২ মার্চ অবশেষে ফ্লাইট ধরে দিল্লি আসা। সেখান থেকে কলকাতা বিমানবন্দর।
তবে দেবমাল্যরা ফিরতে পারলেও ইউক্রেনে আটকে রয়েছে এখনও বহু ভারতীয় পড়ুয়া। তাঁদের ভবিষ্যৎ কি এখনো ভেবেই পাচ্ছেন না তাঁদের পরিবার। ঠিক যেমনটা দেবমাল্য ফেরার আগে অনিশ্চিয়তায় দিন কাটাচ্ছিলেন তার বাবা-মা। ২৮ ফেব্রয়ারি ইউক্রেন থেকে বেরোনোর উদ্দেশ্যে দেবমাল্যরা যখন রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল, সেই সময় নেটওয়ার্ক ইস্যুতে দুদিন তাদের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ করতে পারেনি তার বাড়ির লোকেরা। সেই দুদিন যে কিভাবে কেটেছে না ভাবলে এখনো শিউরে উঠছে দেবমাল্যর পরিবার