বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ ভাবে বেড়ে চলেছে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা। কেন বাড়ছে এই রোগ– কীভাবে রেহাই পাওয়া যেতে পারে– এ বিষয়ে জানাচ্ছেন– ডা. সেখ হাম্মাদুর রহমান– কনসালট্যান্ট– এন্ডোক্রিনলজি ও ডায়াবেটিস বিভাগ– মেডিকা হাসপাতাল
সাক্ষাৎকার ওসিউর রহমান
ডায়াবেটিস কী ধরনের রোগ?
ডায়াবেটিস হল একটি বিপাকজনিত রোগ যেখানে ব্লাড সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। এটা হচ্ছে একটা ক্রনিক ডিজিজ– যে রোগটা একবার হলে দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে ভোগায়।
ডায়াবেটিস হওয়ার কারণ মূলত দুটো— শরীরে ইনসুলিন হরমোনের (যেটি রক্তশর্করা নিয়ন্ত্রণ করে) কাজ না করতে পারা ও ইনসুলিন ক্ষরণ কম হওয়া।
ডায়াবেটিসের ফলে হার্ট অ্যাটাক– হার্ট ফেলিউর– ব্রেন স্ট্রোক– কিডনি ফেলিওর–দৃষ্টিহীনতা– নার্ভের সমসা– পায়ের আলসার ইত্যাদি হতে পারে। এছাড়াও ডায়াবেটিস রোগীদের যৌন অক্ষমতা এবং চর্মরোগ বেশি হয়।
আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাবার কারণ কী?
প্রধান কারণ হল আমাদের দৈনন্দিন জীবনশৈলীর পরিবর্তন। সেই জন্য টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে লাইফস্টাইল ডিজিজ বলা হয়। আগের চেয়ে এখন আমাদের স্ট্রেস কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে রেডিমেড ফাস্ট ফুড খাবারের প্রবণতা। ফাস্ট ফুডে থাকে অতিমাত্রায় তেল– প্যাকজিংয়ের জন্য খাবারে দেওয়া হয় নুন। এইগুলো খাওয়ার ফলে ব্লাড প্রেসার– কোলস্টেরল অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বেড়ে চলে। তার উপর শরীরচর্চার মানসিকতা একদম জিরো হয়ে গেছে।
এই রোগের মূল কারণ কী?
রোগের মূল কারণ হচ্ছে ইনসুলিন ডেফিসেন্সি তথা অটো ইমিউন ডিজিজ। আমাদের শরীরের যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে তারা অনেক সময় মনে করে যে শরীরের কোনও কোনও অংশ– কোনও কোনও ধরনের প্রোটিন যেটি শরীরের নয়। তাই তার বিরুদ্ধে ইমিউনিটি তৈরি করতে শুরু করে। ইনসুলিন যেখান থেকে তৈরি হয় সেই গ্রন্থিটির নাম প্যাংক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়। এই গ্রন্থিতে চার ধরনের সেল থাকে– তার মধ্যে বিটা সেল ইনসুলিন তৈরি করে। কোনও কারণে এই বিটা সেলের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি তৈরি হলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস কাদের হয়?
সাধারণত কম বয়সীদেরই বেশি হয়। এমনকি ১ বছরের শিশুরও এটা হতে পারে। আর টাইপ-২ ডায়াবেটিস যেটা শতকরা নব্বই ভাগ তিরিশোর্দ্ধদের ক্ষেত্রে হয়। তবে আজকাল ২০-২৫ বছর ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রেও হয়। এছাড়াও দেখা যায় গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস এবং সেকেন্ডারি ডায়াবেটিস (যেখানে অন্য রোগের কারণে বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ডায়াবেটিস হয়)। টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ আর টাইপ-১ পাঁচ শতাংশ।
কাদের ডায়াবেটিস হতে পারে?
যাদের ওজন বেশি থাকে– বাবা-মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে– ব্লাড প্রেসার– কোলস্টেরল বেশি থাকলে– যাদের পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ (পিসিওডি) আছে– যাদের হার্ট অ্যাটাক/স্ট্রোক হয়েছে– যাদের কিডনির সমস্যা আছে।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে কী কী সমস্যা হতে পারে?
গর্ভাবস্থায় শরীরের– হরমোনের অনেক পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের কারণে কোন কোনও মায়ের ডায়াবেটিস হতে দেখা যায়। তখন পুরো গর্ভাবস্থাকালীন সময় ইনসুলিন নিতে হয়। এক্ষেত্রে প্রায় ৯০ শতাংশ মহিলার প্রসবের পরে ঠিক হয়ে যায়। তবে ভবিষ্যতে ওইসব মহিলাদের ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। জন্মগত বাচ্চার ডায়াবেটিস না থাকলেও ভবিষ্যতে বাচ্চার ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা কিন্তু বেশিই থাকে। গর্ভকালীন সুগার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শিশুর জন্মগত কিছু ত্র&টি দেখা দিতে পারে। যেমন হার্টের ভাল্ব বা পর্দায় ফুটো হতে পারে– স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভের সমস্যা– চোখের সমস্যা হতে পারে।
ডায়াবেটিস হয়েছে বুঝব কীভাবে?
বার বার বাথরুমে যাওয়া– বার বার পিপাসা লাগা এবং খিদে পাওয়া– হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া– ক্লান্তি ও দুর্বলতা ভাব– যৌনক্ষমতা হ্রাস পাওয়া– বার বার ঘা হওয়া– কোনও ক্ষত হলে তা সহজে না শুকানো– হার্ট ও কিডনির সমস্যা– হঠাৎ করে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া– এমনকী স্ট্রোকও কারও কারও ডায়াবেটিস হওয়ার লক্ষণ হিসাবে দেখা দিতে পারে।
কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন?
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। উপরোক্ত সমস্ত লক্ষণ যদি নাও থাকে তাহলেও চল্লিশোর্দ্ধ ব্যক্তিদের ১-৩ বছর অন্তর নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত।
প্রাথমিক স্তরে ধরা পড়লে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?
তার জন্য চাই জীবনশৈলীর পরিবর্তন। বাদ দিতে হবে ফাস্ট ফুড– নিতে হবে হেলদি ডায়েট। খেতে হবে পর্যাপ্ত মরশুমি শাকসবজি ও ফল– শর্করা জাতীয় খাবারের (ভাত) পরিমাণ কমাতে হবে– ব্রেকফাস্ট ও রাতে রুটি সবজি খাওয়া অভ্যাস করতে হবে। সঙ্গে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। কম করে ৪০-৪৫ মিনিট নিয়মিত হাঁটতে হবে। এগুলো করলেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে কী ধরণের বিপদ হতে পারে?
কিডনি ফেলিওর– হার্ট অ্যাটাক– ব্রেন স্ট্রোক বা প্যারালাইসিসের মত মারাত্মক রোগ হতে পারে। দৃষ্টি চলে যেতে পারে। ধমনীগুলো আস্তে আস্তে শুকিয়ে আসে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে।
ডায়াবেটিস আছে– ঘা ভালো হচ্ছে না— কী করব?
নিজে নিজে চিকিৎসা না করে ভালো চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। চিকিৎসকের পরামর্শমত সুগারটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন– ঘা না শুকোলে কিছুদিনের জন্য ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিতে হতে পারে। হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন না। অবহেলা করে ঘা দীর্ঘদিন ফেলে রাখবেন না। এতে কিন্তু সমস্যা আরও ভয়াবহ হতে পারে– এমনকি অঙ্গহানিও হতে পারে।
একবার ইনসুলিন শুরু হলে কি চিরকাল নিতে হয়?
এ ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। যদি অল্প কিছুদিনের জন্য ইনসুলিন নেবার প্রয়োজন হয় তাহলে তা অবশ্যই নিতে হবে। এর সঙ্গে চিরকাল নেবার কোনও সম্পর্ক নেই।
রক্তে শর্করা বেড়ে বা কমে গেলে কী সমস্যা দেখা দেয়? এ ক্ষেত্রে কী করণীয়?
বার বা বাথরুমে যাওয়া– যৌনাঙ্গে ইনফেকশন– ওজন কমে যাওয়া– শারীরিক দুর্বলতা। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মত ওষুধ– এক্সারসাইজ এবং ডায়েট কন্ট্রোল করতে হবে। আর রক্তে শর্করা কমে গেলে বুক ধরপড়– ঘাম হওয়া– হাত-পা কাঁপা– ক্ষিদে পাওয়া– মাথা ঘোরা– চোখে অন্ধকার দেখা যায়। খুব বেশি শর্করা কমে গেলে অজ্ঞান হওয়া বা খিঁচুনি এমনকি জীবনহানিও হতে পারে। এক্ষেত্রে তিন চামচ গ্লুকোন-ডি খাইয়ে দিতে হবে। যদি হাতের কাছে গ্লুকোন-ডি না থাকে তাহলে চিনি বা অন্য কোনও মিষ্টি খাবার খাওয়াতে হবে। রোগী যদি অচেতন হয়ে যায় তাহলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার।
ভাত– আলু ইত্যাদি খেতে মানা করা হয়– কিন্তু তা তো সবসময় মানা সম্ভব নয়…
ভাত বা আলু খাওয়া একেবারে বারণ নয়– তবে তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা উচিত। এব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া উচিত।
ডায়াবেটিস কি পুরোপুরি সারে?
সাধারণত এই রোগ পুরোপুরি সারে না। তবে জীবনশৈলীর পরিবর্তনের মাধ্যমে রোগী তাঁর রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। অনেক সময় কয়েক বছর বিনা ওষুধেও চলতে পারে।
কী কী খাবার খেলে ডায়াবেটিকরা সুস্থ থাকতে পারেন?
কোনও খাবারই একদম বারণ নয়। ডায়াটেশিয়ান এবং ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে ডায়েট ঠিক হওয়া উচিত। তবে সরল শর্করার জায়গায় জটিল শর্করা বেশি খেতে হবে। সবুজ সবজি এবং ফলমূল (আপেল– পেয়ারা– ন্যাসপাতি– পেঁপে– কমলালেবু– মোসাম্বি– জাম– জামরুল ইত্যাদি) বেশি পরিমাণে খেতে হবে। দুধ বা দুধজাত দ্রব্য খাওয়া উচিত।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কী করণীয়?
যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার রিস্ক বেশি তাদের কৈশোর অবস্থা থেকেই সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ব্যায়ামের পাশাপাশি খাদ্যাভাসের পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। ওজন বেশি হলে কমাতে হবে। স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা পরিহার করতে হবে। নিয়মিত যোগা– মেডিটেশন বা নামায পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম এই ক্ষেত্রে। ডায়াবেটিস রোগীর সুস্থ থাকার জন্য পরিমিত আহার– নিয়মিত শরীরচর্চা– ডাক্তারবাবুদের পরামর্শমত ওষুধ সেবন এবং নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার বিকল্প নেই।