পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: ১৫২ বছরের পুরনো ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদোহ আইনে স্থগিতাদেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। বুধবার এক ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট ব্রিটিশ আমলের এই বিতর্কিত আইনটিকে আপাতত স্থগিত রাখার নির্দেশ জারি করেছে। এই আইন বারবার সমালোচনার ঝড় তুলেছে দেশে। স্বাধীনতার আগে বালগঙ্গাধর তিলক, মহাত্মা গান্ধিকে এই আইনবলে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। তারপর দেশ স্বাধীন হয়েছে।
ব্রিটিশরা দেশ ছাড়লেও রয়ে যায় আইনটি। মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার দেশে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই আইনের ‘প্রয়োগ’ও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আইনটির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। এই প্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালত আইনটি নিয়ে কেন্দ্রের কাছে হলফনামা চেয়েছিল। সময় দিয়েছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। কেন্দ্রের জবাব পাওয়ার পরেই এ দিন শীর্ষ আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এই আইনে আর কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না।
ইতিমধ্যেই এই আইন প্রয়োগ করে যে সমস্ত মামলা আদালতে চলছে, তা স্থগিত হয়ে যাবে। এই আইনের বলে বন্দিরা এবার জামিনের আবেদনও করতে পারবেন বলে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে আইনটি পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দিয়েছে। পুনর্বিবেচিত না হওয়া পর্যন্ত এই আইনের অধীনে কোনও মামলা করা যাবে না বলে শীর্ষ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে। তিন সদস্যের এই বেঞ্চের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে জোর ধাক্কা খেয়েছে কেন্দ্র, মনে করছে ওয়াকিফহাল মহল। কারণ, এই আইনটি তাদের শাসনামলে বিরোধী কণ্ঠকে রোধ করার জন্য রীতিমতো ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠেছিল। কেন্দ্র যে খুশি নয়, তার আভাস পাওয়া গিয়েছে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজুর মন্তব্যেই। তিনি বলেন, আদালতের স্বাধীন সত্তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, সবকিছুরই একটি ‘লক্ষ্মণরেখা’ থাকে। সেটি অতিক্রম করা ঠিক নয়। আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়েছিলাম। এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছাও আদালতকে জানানো হয়েছিল।
দেশের সংবিধান ও আইনের উপর সবাইকে শ্রদ্ধা রেখে চলতে হবে। অনেকটা তির্যক ভাষাতেই তিনি বলেন, আদালতের উচিত সরকার ও আইনসভাকে শ্রদ্ধা করা। তাহলে তারাও পরিবর্তে শ্রদ্ধা পাবে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রদোহ আইনে স্থগিতাদেশের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই আইনের বিরুদ্ধে অন্যতম মামলাকারী টিএমসি সাংসদ মহুয়া মৈত্র একে ‘বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, গণতন্ত্রের জন্য এটি একটি দারুণ দিন। সুপ্রিম কোর্টকে স্যালুট!
ভারতীয় দণ্ডবিধির ‘১২৪-এ’ ধারার এই রাষ্ট্রদোহ আইনটি নিয়ে বিতর্ক চলছে অনেক দিন ধরেই। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন (২০১৬) ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদদের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করে মামলা করা নিয়ে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। এই আইন রদ করা নিয়ে ক্রমেই জনমত গড়ে উঠছিল দেশে। গত সোমবার আদালতে এই বিতর্কিত আইন পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল কেন্দ্র। মঙ্গলবার আইন পুনর্বিবেচনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত, এই আইনের অধীনে হওয়া মামলাগুলি আপাতত স্থগিত রাখার বিষয়ে রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল শীর্ষ আদালত। তবে, এ দিন আদালতে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বলা হয় কোনওভাবেই আইনটির অনুশীলন স্থগিত রাখা যাবে না।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের এবং দ্রুত জামিনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে রাজ্যগুলিকে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বলেন, ইতিমধ্যেই দায়ের হওয়া মামলাগুলি স্থগিত রাখার বিষয়টি পুলিশ বা সরকারের এক্তিয়ারে নেই। কারণ, এই মামলাগুলির শুনানি চলছে আদালতে। আদালতই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তুষার মেহতা আরও বলেন, সারা ভারতে অপরাধের তীব্রতা আমরা জানি না। এই মামলাগুলির ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের মতো গুরুতর অভিযোগও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে আইন স্থগিত না রেখে, এই মামলায় অভিযুক্তদের জামিনের আদেশের সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। রাজ্যগুলিকে এই মর্মে নির্দেশ জারি করা যেতে পারে যে, পুলিশ সুপার বা তার চেয়ে উচ্চপদস্থ কেউ এই মামলাটি দায়ের করতে পারবে। কিন্তু কেন্দ্রের এই যুক্তিতে সায় দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট।
আইনটির সাংবিধানিক বৈধতা অতীতেও বিচার করা হয়েছে, উল্লেখ করে আইনটির অনুশীলন স্থগিত রাখার বিরোধিতা করেন মেহতা। তারপরও আইনটির অনুশীলন আপাতত স্থগিত রাখল আদালত। এর আগে প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন বাতিলের দাবিতে দায়ের করা একটি মামলার শুনানির সময়ে মৌখিক মন্তব্য করতে গিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও কেন ব্রিটিশ যুগের এই আইনটি এখনও কার্যকর রয়েছে।
বিজেপি শাসিত কেন্দ্র সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার এই আইনটিকে ভিন্নমত দমনের কাজে অপব্যবহার করছে বলেও জানিয়েছিল আদালত। যে আইন ঔপনিবেশিক প্রশাসন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করত, সেটার এখনও প্রয়োজন কেন, এই প্রশ্নও তুলেছিল আদালত। সম্প্রতি একের পর এক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। শীর্ষ আদালতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারা বা রাষ্ট্রদ্রোহ আইনকে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এক সপ্তাহ আগেই মোদি সরকার আদালতে জানিয়ে দিয়েছিল, এই আইন পুনর্বিবেচনা করার কোনও পরিকল্পনা নেই তাদের। তবে আদালতের সিদ্ধান্ত তাদের বিপক্ষেই গেল।