মোহনা কাঞ্জিলাল: চিনের পর ভারতের বিশ্বের বৃহত্তম চা-উৎপাদনকারী দেশ। এর জন্য ব্রিটিশদের ধন্যবাদ জানাতে হয়। অসম ও দার্জিলিঙে তারাই প্রথম চা চাষ করা শুরু করে। শুধু তাই নয়, উত্তর-পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে চা উৎপাদনের শুরুও হয়েছিল তাদের হাত ধরেই। ব্রিটিশরা যত বেশি পরিমাণে চা খেতে আরম্ভ করে ততই এই শিল্পের রমরমা বৃদ্ধি পায়। চা চাষও বাড়ে। ১৮৮৮ সালের মধ্যে অসম, দার্জিলিং ও অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল থেকে ব্রিটেনে চা রফতানির হার চিনকেও ছাপিয়ে যায়।
প্রখ্যাত চা গবেষক অরূপ কুমার চ্যাটার্জি লেখেন, ১৮৮৮ সালের মধ্যে ভারত থেকে ৮৬ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি চা রফতানি করা হয় ব্রিটেনে। এদিকে, চিন থেকে যেত প্রায় ৮০ মিলিয়ন পাউন্ড। ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘এ থার্স্ট ফর এমপায়ার : হাও টি শেপড দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থে এমনটাই উল্লেখ করেছেন এরিকা র্যাপাপোর্ট। চিনকে পিছিয়ে পড়া ও প্রতারক প্রমাণ করতে ভিক্টোরিয় লন্ডনে ভারতের চায়ের বিপুল প্রচার করা হত। বিপুল পরিমাণ ভেজাল চিনা চা বাজেয়াপ্ত করে কাস্টমস দফতর এবং সেই চা টেমসের জলে ফেলে দেওয়া হয়। বিপরীতে, বিজ্ঞাপিত করা হত যে, ভারতীয় চা সুগন্ধ ও স্বাদে চিনের চায়ের চেয়ে সুন্দর। এমন ঘোষণাও করা হয়, ভারতের চা তুলনামূলকভাবে অনেক খাঁটি, তেজি, সস্তা ও ভাল। দার্জিলিং ও অসমের চা সুদৃশ্য কাঠের বাক্সে প্যাক করে লন্ডনের চা-দোকানে বিক্রি হত। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ‘থিসিস ইলেভেন : ক্রিটিকাল থিওরি অ্যান্ড হিস্টোরিকাল সোশিওলজি’ নামে একটি অ্যাকাডেমিক জার্নালে ফিলিপ লুতজেনডর্ফ ‘মেকিং টি ইন ইন্ডিয়া : চায়, ক্যাপিটালিজম, কালচার’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি বর্ণনা করেন, ভারতীয় গ্রাহকদের মধ্যে চা-কে জনপ্রিয় করার পরিকল্পনা দেরিতে নেয় ব্রিটিশ প্রভুরা। এ দেশে চা চাষের প্রচলন শুরু করা হয়েছিল মূলত পশ্চিমে রপ্তানি করার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে অ্যাংলোফাইল ভদ্রলোক ও অভিজাতবাবু সম্প্রদায় চিনা মাটির পাত্রে চায়ের স্বাদ নিতে শুরু করেন। তবে দুধ ও চিন সহযোগে। যদিও ভারতীয় চা-পায়ীদের সংখ্যা ছিল নিতান্ত কম। লিকার চায়ের চলন শুরু হয় অপেক্ষাকৃত পরে। যাইহোক, লন্ডনে চায়ের নিলাম মূল্যের হেরফের ও পরিবহণঘটিত অসুবিধার কারণে দেশীয় বাজারের দিকে বিশেষভাবে নজর দেয় ঔপনিবেশিক শিল্পপতিরা। ১৯০১ সালে ভারতের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে চায়ের প্রচলন শুরু করেন ভাইসরয় কার্জন। কিন্তু সেই নিরীক্ষায় তেমন সাফল্য আসেনি বলে ১৯০৪ সালে কার্জন ওই উদ্যোগ বাতিল করেন। ১৮৮১ সালে ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়, তিন বছর লাগাতার চেষ্টা সত্ত্বেও ভারতে চায়ের বাজার তেমন আশাব্যঞ্জক ফল দেয়নি। চা সরবরাহের জন্য রেলপথ বিস্তার করে বিনামূল্যে কাপ বিলিয়ে দেশীয় মহিলাদের প্রাথমিকভাবে নিশানা করেও সাফল্য আসেনি। এ দেশে ঐতিহ্যবাহী শরবতই বেশি জনপ্রিয় ছিল।