আহমদ হাসান ইমরান: ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের সেনা ও বিমান বাহিনীর নৃশংস আক্রমণ জারি রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ ও ভয়ংকর সব সমরাস্ত্রের জোগান। বিভিন্ন সূত্র এও বলছে, আমেরিকার বিশেষ প্রশিক্ষিত কমান্ডো বাহিনী ইসরাইলে চলে এসেছে এবং তারা ইসরাইলের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। অস্ত্র পাঠাচ্ছে জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি পশ্চিমা দেশও।
তবে একটা কথা পরিস্কার, ইসরাইল যুদ্ধের এক মাস পাঁচ দিন পরও হামাসকে পরাজিত করতে পারেনি। গাজায় সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়ার পরও যায়নবাদীদের ট্যাঙ্ক বাহিনী এখনও স্থলযুদ্ধে গাজার দখল নিতে পারেনি। এই যুদ্ধে একটা কথা পরিস্কার, ইসরাইল অপরাজি শক্তি, তার রয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, রয়েছে আয়রন ডোম।
এইসব কথা যে ফানুস মাত্র, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। মুখোমুখি যুদ্ধে ইসরাইল যে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পেরে উঠবে না, তা এখন পরিস্কার। এমনিতেই হিজবুল্লাহর ভয়ে ইসরাইলি সেনা ও নাগরিকরা আতঙ্কে থাকে। ২০০৬ সালের যুদ্ধে রাষ্ট্রহীন সংগঠন হিজবুল্লাহ ইসরাইলকে ভালোই সবক শিখিয়ে দিয়েছিল।
খোদ রাষ্ট্রসংঘ বলেছে, ইসরাইল ছোট্ট জনপদ গাজাকে জাহান্নামে পরিণত করেছে। বলেছে, পৃথিবীতে জাহান্নাম দেখতে হলে গাজাই হচ্ছে তার জলজ্যান্ত নজির।
গাজার শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ক্র¨নরত, শোকগ্রস্ত। ক্রুদ্ধ মুখগুলি বলে দিচ্ছে, আগামীতে যারা বেঁচে থাকবে তারা অবশ্যই কোনও না কোনওভাবে ইসরাইল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে। আমেরিকা ও পশ্চিমাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সবার প্রতি স্বাধীনতা, বিনা বিচারে হত্যায় নিষেধাজ্ঞা, সাধারণ বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে বোমা বর্ষণ বা হত্যাযজ্ঞ চলবে না- এইসব শ্লোগান যে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে তা গাজার ঘটনাবলী স্পষ্টভাবে সামনে এনেছে। মুখোশ একেবারেই পৃথিবীর সচেতন মানুষের কাছে খুলে গেছে।
এখন একটি গুরুতর প্রশ্ন সামনে এসেছে। ইহুদি হত্যাযজ্ঞের কথিত অভিযোগের জন্য দায়ী নাৎসীবাদী হিটলার কি বেশি নৃশংস ছিল? নাৎসীবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে, তাদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হিটলার নাকি ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছিল। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলি অন্তত পক্ষে বন্দি ইহুদিদের জন্য পানি ও খাবারের বন্দোবস্ত খানিকটা হলেও চালু ছিল। যায়নবাদীরা বলে, ইহুদিদের হত্যা করা হয়েছে গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে। সেখানে গ্যাস দ্বারা নাকি ইহুদিদের হত্যা করা হয়। হয়তো এই ধরনের হলোকাস্ট হতেও পারে। যদিও এ নিয়ে এখন নতুন নতুন গবেষণা চলছে। বেশকিছু কন্সপিরেসি থিওরি ইহুদিদেরই তৈরি গুগলে সার্চ করলে পাওয়া যায়।
যে প্রশ্নটির কথা বলা হচ্ছিল, সেটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মনে করি প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখের। তা সে ইহুদিরই হোক কিংবা মুসলিম বা খ্রিস্টানের। অকারণে এবং নিরাপরাধদের জীবন নেওয়ার অধিকার কারও নেই। কিন্তু প্রশ্নটি হল, কোনটা বেশি নৃশংস? কোনটা বেশি মানবিকতা বিরোধী? ইহুদিদের উপর কথিত হলোকাস্ট, নাকি ফিলিস্তিনের গাজায় সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে ইসরাইলিদের লাগাতার হামলা, নরসংহার এবং ধ্বংসযজ্ঞ? গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাসিন্দা-সহ মানুষের ঘরবাড়ি। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পানি, খাবারের সরবরাহ, ত্রাণ এবং বিদ্যুৎ। বুঝতেই পারা যায়, রাষ্ট্রসংঘের এক প্রতিনিধি কেন গাজাকে বলেছেন ‘জীবন্ত জাহান্নাম’। ইতিমধ্যেই শুধুমাত্র গাজায় ইসরাইলি নরসংহারে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১২,০০০ ছুঁতে চলেছে। এদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী। আহতের সংখ্যা ২৫-২৬ হাজার। অনেকে এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে রয়েছেন।
গাজায় যেভাবে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মানুষ মারা হচ্ছে, ফসফরাস বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে, যা নাপাম বোমায় মৃত্যু থেকেও কষ্টদায়ক, আহত হয়েও লোকেরা বেঁচে থাকতে চায় না, তাঁরা বলেন, আমরা মরে গেলে এই ভয়নক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব। গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ফুলের মতো শিশুর মাথা, বেরিয়ে যাচ্ছে নাড়িভুড়ি। গ্যাস চেম্বারে মরার সময় ইহুদিদের কতটা কষ্ট হয়েছে তা হয়তো বিশেষজ্ঞরা বলবেন। কিন্তু এখানে সারা পৃথিবী টেলিভিশনে দেখতে পাচ্ছে, গাজার নারী-পুরুষের কষ্টদায়ক মৃত্যু ও বাঁচার জন্য ছোটাছুটি। নেতানিয়াহু এবং জো বাইডেন উভয়ের সামনে রয়েছে নির্বাচন। তাঁরা নির্বাচনকে সামনে রেখে নরসংহারে মেতেছেন।
এটা বলছেন পাশ্চাত্যের পর্যবেক্ষকরাই। প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে, যে হলোকাস্ট নিয়ে ইহুদিরা এত বেশি প্রচার করে মানুষের সমবেদনা অর্জনের চেষ্টা করে, তা বেশি ভয়াবহ না গাজায় ধ্বংস ও মৃত্যু-স্রোত বেশি নৃশংস। বোঝা যাচ্ছে, দুনিয়াতে মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার, জীবন ও সম্পত্তির অধিকারের আর কোনও দাম নেই।
আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা এগুলির পক্ষে কথা বললে এবার থেকে বিশ্বের মানুষ বলবে, কত্তা একটু আসতে কন। ঘোড়ায় শুনলেও হাসব।