ডা. শামসুল হক
এই বিশ্ব নিখিলে শক্তির এই যে এত বাড়বাড়ন্ত তার অনেকটাই সুসম্পন্ন হয়েছে কেবলমাত্র সূর্যকিরণের দৌলতেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বড় বড় বিশেষজ্ঞরাও মেনে নিয়েছেন সেই একই কথা। মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রক হিসেবে সূর্যালোকের ভূমিকা যে বিশাল তা স্বীকার করে নিয়েছেন সকলেই।
বিভিন্ন বৈচিত্রতায় ভরা সেই রৌদ্রকিরণ যে কতখানি মোহময় তা আমরা অতি সহজেই উপলব্ধি করতে পারি দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মাধ্যমেই। সূর্যের আলো যার উপরেই প্রতিফলিত হোক না কেন, তার একটা হিতকর প্রভাব পরিলক্ষিত হবেই হবে।
প্রথমেই আমাদের দেহের কথাটাই ধরা যাক। সূর্যের আলো আমাদের দেহের উপর পড়লেই তা সমগ্র মনপ্রাণকেই একেবারে চনমনে করে তোলে। দেহের ত্বক সর্বপ্রথম নেয় তার স্বাদ। তারপর তা দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে চামড়ার মাধ্যমেই এবং রক্ত দ্বারা শোষিত হয়। আর তারই ফলস্বরূপ জীবকোশগুলিও উদ্দীপিত হয়ে ওঠে এবং তা শারীরিক গঠন অথবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজকর্মের পক্ষে বেশ সহায়কের ভূমিকাই পালন করে থাকে। ফলে আমাদের দেহ তখন যেমন সুগঠিত হয়ে ওঠে– ঠিক তেমনই বাড়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও।
শরীর– মন এবং রোদ্দুরের এই খেলা যদি ঠিক নিয়মমাফিকভাবেই চলে, তাহলে রক্তসঞ্চালন ক্রিয়াও ঠিকঠাকভাবে সম্পাদিত হয়। আর কোনও কারণে যদি শরীরের কোনও অঙ্গে রক্তবদ্ধতার সৃষ্টি হয়– তাহলে তাও দূরীভূত হয় অতি সহজেই। ফলে প্রতিটি মানুষ যেমন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে– তেমনই ঘুমের ক্ষেত্রেও আসে না কোনও প্রতিবন্ধকতাই। আবার তার ফলে শরীরটাও থাকে বেশ ঝরঝরে।
সূর্যালোক গ্রহণের পর আমাদের দেহের স্নায়ুমণ্ডলগুলি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে আর তার ফলস্বরূপ আপনা-আপনিভাবেই বেড়ে যায় আমাদের মানসিক কর্মক্ষমতাও।
সূর্যকিরণের প্রভাব মানুষ ছাড়াও অন্যান্য জীবজন্তু এবং জলের মাছ বা অন্যসব সরীসৃপ প্রাণীদের ক্ষেত্রেও অতি আবশ্যিক এক মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয় একেবারে নিশ্চিতভাবেই। আর গাছগাছালিদের ক্ষেত্রেও রোদ্দুরের ভূমিকা যে কি বিশাল তা আর নিশ্চয়ই নতুনভাবে বোঝাবার প্রয়োজন নেই। গাছের সবুজ পাতা সবুজাভ হয়ে ওঠা সেতো সম্পন্ন হয় কেবলমাত্র সূর্যালোকের প্রভাবেই। ঝলমলে রোদ্দুরের মাধ্যমেই গাছের পাতা শক্তি সঞ্চয় করে এবং তারপর সেই শক্তির বিনিময়েই তারা একসময় ফলে– ফুলে ও মুকুলের সমাহারে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে।
গাছপালার সহায়তা ছাড়া মানুষ-সহ অপরাপর জীবজন্তুর দল এবং পাখিদের পর্যন্ত বাঁচা সম্ভব নয়, একটি মুহূর্তও। তাই আমরা প্রত্যক্ষভাবে যেমন সূর্যকিরণের কাছে ঋণী– তেমনই দায়বদ্ধ পরোক্ষভাবেও। কারণ গাছপালা ছাড়া আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় একটি মুহূর্তও।
সূর্যরশ্মির অসীম ক্ষমতার দৌলতেই কিছুটা হলেও স্বস্তির মুখ দেখার সুযোগ নিশ্চয়ই পেতে পারেন মধুমেহ– বিভিন্ন ধরনের বাতব্যাধি-সহ বহুবিধ চর্মরোগে আক্রান্ত রোগীরাও। অজীর্ণ রোগের রোগীরাও যদি নিয়মিতভাবে রোদ্দুরের উত্তাপ গ্রহণে উৎসাহী হন, তাহলে নিশ্চয়ই অনেক সুফল পাবেন। কারণ এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের চামড়া যখন শুষ্ক হয়ে ওঠে তখন তাদের রক্তের মধ্যেও দেখা দেয় নানান দোষত্রুটি। আর ঠিক তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে রৌদ্রস্নানের– নিজের শরীরটাকে সতেজ এবং তরতাজা করার তাগিদেই।
সূর্যকিরণের যে একটা বিশেষ জীবাণুনাশক ক্ষমতা আছে, সেটা নিশ্চয়ই সকলের অজানা থাকার কথা নয়। তাই কেবলমাত্র নিজেকে সুস্থ রাখার প্রয়োজনেই যে আমাদের তার স্বাদ গ্রহণ করা অতি আবশ্যিক এক কর্তব্য, সেটা মনে রাখা খুবই প্রয়োজন।
সূর্যের আলোর মাধ্যমে আমাদের দেহের রক্ত উৎপাদনের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় অনেকটাই। তা ছাড়াও সূর্যরশ্মির আরও গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হল রক্তকে পরিশুদ্ধ করা। আবার হাঁপানি রোগীরা যদি নিয়মিতভাবে এই আলোকে দেহের উপর প্রতিফলিত করতে পারে– তাহলে এগিয়ে যেতে পারবে অনেকটাই সুস্থতার পথে। সূর্যালোকের মাধ্যমেই আমাদের দেহে সঞ্চিত হয় ক্যালসিয়াম– ফসফরাস-সহ আরও অনেক সম্পদ।
একজন মানুষের বাঁচার তাগিদে সূর্যালোকের প্রয়োজন যে কতখানি, তা সত্যি সত্যিই বোঝান সম্ভব নয়। আর একথাটিও মনে রাখতে হবে যে– সেই রৌদ্রস্নান-পর্ব যেন সম্পাদিত হয় একেবারে সঠিকভাবেই। নতুবা অনেক সময়ই ভুল পদক্ষেপ ফলাফলের ক্ষেত্রে উল্টো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলেও করতে পারে।
সকাল এবং বিকালের ম্লান আলোটাই এই ব্যাপারে সবচেয়ে সহায়ক এক পন্থা বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রখর রৌদ্রে অযথা ঘোরাঘুরি করা কোনওভাবেই উচিত নয়। আর একটা বিষয়েও বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন যে– রৌদ্রস্নানের পর নিজের শরীরকে যেন অতি অবশ্যই স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফিরিয়ে আনা হয়।
সূর্যকিরণের মধ্যেই যে আছে রোগ নিরাময়ের অসীম ক্ষমতা, তা ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন প্রাচীন কালের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা। তাই বিভিন্ন রোগের জন্য ওষুধ নির্বাচন ছাড়াও তাঁরা রোগীদের উপদেশ দিতেন নিয়মিতভাবেই সর্বাঙ্গে সূর্যের আলোটাও যাতে লাগে, সেইদিকে নজর রাখতে। আজকের দিনের আধুনিক চিকিৎসাবিদরাও মেনে নিয়েছেন সেই একই থিওরি– বাঁচার জন্য অতি অবশ্যই চাই সূর্যের উজ্জ্বল রশ্মিটাও।
লেখক জুপিটার ফার্মাসিউটিক্যালসের আয়ুর্বেদ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত গবেষক