ডা. শামসুল হক: স্ট্রোকের নাম শুনলে ভয় পাননা এমন মানুষ পাওয়া বোধহয় সম্ভব নয় । এই রোগ আচমকাই আক্রমণ করে মানুষকে এবং তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটাও বোধহয় অনুমান করা যায় না কোনওভাবেই। আর ভয়াবহতার রূপ দেখে আড়ষ্ট থাকতে হয় সকলকেই। কারণ এই রোগের আগমন মৃত্যুর ঘন্টা বাজানোর জন্য সত্যিই খুব ভয়াবহ ।
একজন মানুষের সবল ও সতেজভাবে বাঁচার জন্য প্রয়োজন শরীরের প্রত্যেকটা কোশ এমনকি মস্তিষ্কের কোশেও অক্সিজেন সঞ্চালনের। কিন্তু কোনও কারণে যদি মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনীগুলির পথ সংকীর্ণ হয়ে ওঠে বা অন্য কোনও কারণেই যদি রক্ত সঞ্চালন ধীর গতিসম্পন্ন হয়ে ওঠে অথবা বন্ধ হয়ে যায়– তাহলে মস্তিষ্কের সব কোশগুলো অক্সিজেনের অভাব অনুভব করে এবং ঠিক তখনই অসহায় সেই মানুষটাকে হতে হয় স্ট্রোকের শিকার।
উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণেই একজন মানুষের সাধারণত এই রোগ হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায় এবং দেখা দিতে পারে নানান সমস্যা। অনেক সময় আবার মাথার ভিতরের রক্তনালিকা কোনও কারণে বন্ধ হয়ে গেলে বা ফেটে গেলেও এই ঘটনা ঘটতে পারে ।
এইসব ছাড়াও একজন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন আরও অন্যান্য অনেক কারণেই। রক্তের মধ্যে যদি কোলেষ্টেরল বেড়ে যায় অথবা বেড়ে যায় শর্করার পরিমাণ তাহলেও হতে পারে স্ট্রোক। আবার নানাবিধ মানসিক চাপ এবং আঘাতের কারণেও যে ঘটতে পারে এহেন ঘটনা তা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরাই। অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করা অথবা দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় যদি বেশি ভাজাভুজি অথবা চর্বিযুক্ত খাবারের সমাহার থাকে তাহলেও হতে পারে স্ট্রোক। ‘ফাস্ট ফুড’ নিয়মিতভাবে গ্রহণ করার অভ্যাসটাও পড়ে এই তালিকার মধ্যেই। তবে চিকিৎসকদের মতে এই রোগে আক্রান্ত হতে বেশি দেখা যায় সেইসব মানুষদেরকেই যারা মদ্যপান অথবা অন্যসব নেশায় অভ্যস্ত। ধূমপায়ীদেরকেও বাদ দেওয়া যাবে না এই তালিকা থেকে ।
স্ট্রোক মানেই যে জীবনহানি তা কিন্তু নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু মারাত্মক এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর অনেককেই একজন প্রতিবন্ধী মানুষ হিসেবেই কাটাতে হয় জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি। সত্যিই সেই জীবন বড়ই যন্ত্রণাময়। আর দীর্ঘদিন সেইভাবে জীবন কাটাতে কাটাতেই অনেকেরই আবার মনে হয়– দুঃসহ এই জীবনের থেকে মৃত্যুই বোধহয় ভালো।
বর্তমান সময়ে সমগ্র বিশ্বজুড়ে স্ট্রোকের প্রবণতা বেড়েছে বলেই বিশ্বের প্রায় সব দেশই তাকে প্রতিহত করার জন্য সচেষ্ট হতে শুরু করেছে। চিকিৎসক– গবেষক এবং বুদ্ধিজীবীদের মিলিত প্রচেষ্টায় তাকে সামাল দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্ট্রোকের আক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইউরোপীয়ান স্ট্রোক অর্গানাইজেশনের কর্মকর্তারা। আর তার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল একটি দিবস পালনের। সেই দিনের নামটাও দেওয়া হয়েছিল বিশ্ব স্ট্রোক দিবস।
১৯৯০ সালের ১০ মে তাঁদের তৎপরতাতেই প্রথম আয়োজন করা হয়েছিল বিশ্ব স্ট্রোক দিবসের। তারপর থেকে প্রতি বছরই ওই দিনে যথাযথভাবে পালিত হয়ে চলেছে সেই দিবস পালন। কয়েক বছরের মধ্যেই মিলতে শুরু করেছে সফলতাও। ফলে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সচেতনতাও বেড়ে যায় অনেকটাই।
২০০৪ সালে নতুনভাবে তৈরি হয় আরও একটি সংস্থা। এই রোগের বিরুদ্ধে সংগ্রামের উদ্দেশ্য নিয়েই সেই সংস্থার কর্মকর্তারা নতুনভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। প্রবীন মানুষদের নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলেন তাঁরা। বলাই বাহুল্য– তারপর থেকেই বিশ্বের সমস্ত বয়স্কদের কাছেই সেই সংস্থা ভালোবাসার নতুন প্রতীক হিসেবেই বিবেচিত হতে শুরু করে ।
স্ট্রোকের এই মারণ ছোবল যে নতুন নয়– এই পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব যে আগেও ছিল তা আমরা জানতে পারি ইতিহাস থেকেই। খ্রিস্টপূর্বেও অতি দাপটের সঙ্গেই সে যে চালিয়ে যেত তার দমননীতি– আমরা জানতে পারি সেটাও।
সেই সময় এই রোগকে ডাকা হতো সন্ন্যাস রোগ নামেই। তবে তখন মানুষের জীবনধারণের পদ্ধতি ছিল একেবারেই আলাদা। তাই রোগটাও মানুষকে আক্রমণ করত একেবারেই নীরবে এবং জীবনহানির ঘটনাও ঘটত একটু বেশিই।
এখন দিন বদলেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া আজ মানুষকে ভীষণভাবেই আবেগপ্রবণ করে তুলেছে। কিন্তু মানুষ যে নিজের অজান্তেই অনেক ভুলভ্রান্তিও করে ফেলছে সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। বলা যেতে পারে– অত্যাধুনিক জীবনযাত্রার প্রবাহের কারণেই মানুষ আজ দিকভ্রষ্ট হচ্ছেন। আক্রান্ত হচ্ছেন নতুন নতুন রোগেও। স্ট্রোক হল সেইসব রোগেরই একটা অংশ মাত্র।
তাইতো এই রোগ থেকে দূরে থাকার জন্য বিশেষজ্ঞরা আজ পরামর্শ দিচ্ছেন– সংযত জীবন ধারার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে। উপদেশ দিচ্ছেন সাধারণ পুষ্টিকর অথচ সহজপাচ্য খাদ্য গ্রহণের জন্য। বলছেন কম তেল– ঝাল-মশলা দিয়ে তৈরি খাবার খেতে। বিরত থাকতে হবে সবধরনের নেশা থেকেও। চলবে না মনের উপর কোনও চাপ রাখা। নেওয়া চলবে না অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ইচ্ছেও। পরিশ্রমের মধ্যেই দিন কাটাতে হবে কিন্তু তা যেন কোনও অবস্থাতেই নিয়ম বহির্ভূত না হয়। চালাতে হবে নিয়মিত শরীরচর্চাও।