আহমদ হাসান ইমরানঃ গাজায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০,০০০ ছুঁতে চলেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান হচ্ছে, নিহত ২৯,৬০৬, মারাত্মক আহত ৬৯,৭৩৭। এছাড়া রয়েছে নিরুদ্দেশ, যাদের কোনও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না, এমন বহু মানুষ। মায়ের চোখের সামনে শিশুরা প্রাণ হারাচ্ছে। মায়েরা সেই মৃত শিশুকেই আঁকড়ে ধরে আছেন। আবার আহত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের তারা বুকে জড়িয়ে আছেন ঠিকই, কিন্তু এই রক্তাক্ত জখমদের নিয়ে কোথায় যাবেন, তার কোনও ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছেন না। কারণ, ফিলিস্তিনের সমস্ত হাসপাতাল যায়নবাদী ইহুদি সেনারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তারা মুর্মূষু শিশু ও নারীদের নাকে-মুখে লাগানো অক্সিজেনের টিউব খুলে নিয়েছে। অক্সিজেন সরবরাহ ও বিদ্যুৎ বিনষ্ট করে দিয়েছে।
এই সবই হচ্ছে সভ্য, গণতন্ত্রী, মানবাধিকারের ধ্বজাধারী আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আরব বিশ্বের তাবড় তাবড় রাজা-বাদশাহ ও স্বৈরাচারি শাসকদের চোখের সামনে। রাষ্ট্রসংঘ, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত কারও কোনও বক্তব্যকে ইসরাইল এবং তার পশ্চিমা খ্রিস্টান সঙ্গীরা আমলই দিচ্ছে না। উপরন্তু যুদ্ধবিরতি লাগু করে হত্যালীলা বন্ধের জন্য রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদ যে প্রস্তাব নিয়েছে, আমেরিকা, ব্রিটেন তাতে তিন তিনবার ভেটো প্রয়োগ করেছে। শেষ দফা ভেটো প্রয়োগ করেছে মাত্র দিন কয়েক আগে। অর্থাৎ ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতির কথাও বলা যাবে না। ইসরাইলের পাশে ভেটো-র গদা হাতে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। বোধহয় তাদের বক্তব্য, মুসলিম বেসামরিক ব্যক্তিদের উপর হত্যাযজ্ঞ চলুক অব্যাহতভাবে। অথচ এরাই মানবতার দাবিদার।
আমাদের দেশ ভারতেও কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা নিধনযজ্ঞের নায়ক নেতানিয়াহুর পাশে। তাদের সমর্থন, বক্তব্য যায়নবাদী ইহুদিদের হাতকে মজবুত করছে। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থাও তথৈবচ। কিছু রাজনৈতিক দল গাজায় চলমান হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে একটিও বাক্য খরচ করেননি। নজির হিসেবে, আপ-এর কথা বলা যেতে পারে। কেজরিওয়ালরা মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন।
এর মধ্যে কংগ্রেস দলের নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধি ব্যতিক্রম। প্রথমদিন থেকেই তিনি গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ও হত্যাযজ্ঞের নিন্দা করে আসছেন। নিন্দা করে চলেছেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। ২৪ ফেব্রুয়ারি এক্স হ্যান্ডেলে প্রিয়াঙ্কা গান্ধি এই নিধনযজ্ঞের তীব্র নিন্দা করেছেন। ইতিমধ্যে রাফায় জড়ো হওয়া অসহায় মানুষদের উপর ইসরাইল প্রবল হামলা চালিয়েছে। ফলে ফিলিস্তিনিদের নিহত ও আহতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক মহল আশা করেছিল, রাফায় জড়ো হওয়া বেসামরিক মানুষদের উপর ইসরাইল হামলা চালাবে না। কিন্তু এসব কথা শুনতে ইসরাইলিদের বয়ে গেছে। তারা এখন মার্কিন সহায়তায় আরব ভূমিতে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর পবিত্র মসজিদুল আক্সাকে সম্পূর্ণ নিজেদের হেফাজতে নিতে চায়।
যাই হোক, অন্তত ভারতের একজন নেত্রী এই আগ্রাসন, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারকীয় হত্যালীলার সাহস ভরে প্রতিবাদ করে চলেছেন। তিনি হচ্ছেন কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা গান্ধি। শনিবার এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লিখেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজাতে যে (নৃশংসতার) অনুমতি দিয়েছে, তা ইতিহাসে মানবতার জন্য এক বিশাল লজ্জা হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর এই হত্যাযজ্ঞ মানব জাতির জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধি আরও লিখেছেন, ‘জেনোসাইডের দিকে চোখ অন্ধ করে রাখা হচ্ছে। ঘাতকরা ধরে নিচ্ছে, তাদের কোনও দায় স্বীকার বা জবাবদিহি করতে হবে না।
আমরা হাজার হাজার নিরাপরাধ শিশুদের নির্দয় হত্যালীলার প্রতি পিঠ ঘুরিয়ে নিচ্ছি। আমরা এতে কোনও হস্তাক্ষেপ করতে রাজি নই। আর অন্যদিকে একটি পুরো জাতি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মুমূর্ষু হয়ে রয়েছে। তারা সাহায্যের জন্য আবেদন করে যাচ্ছে। হাসপাতালগুলিতে বোমা ফেলা হচ্ছে। চিকিৎসকদের উপর নির্যাতন হচ্ছে, তাদের অপমান করা হচ্ছে। আর হাসপাতালের রোগীদের মরার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
অত্যাচারী এক শাসক গোষ্ঠীকে আমরা হত্যায় সক্ষম করে তুলছি আমাদের বর্বরগুলি তাদের জাহাজকে নোঙর করতে দিয়ে। অমানবিক আগ্রাসনকে আরও অর্থ এবং অস্ত্র সরবরাহ করে নৃশংস তাণ্ডব চালাতে দিচ্ছি। ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের সমস্ত নিয়ম-নীতি, মানবিকতা ও আন্তর্জাতিক শালীনতার সমস্ত আইন ও প্রথাকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। মানবিকতা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এবং আমাদের প্রত্যেককে একদিন না একদিন এর মূল্য চোকাতে হবে। আমরা যদি আজও আওয়াজ না তুলি, যদি সত্য ও ইনসাফের পক্ষে না দাঁড়াই, তাহলে মানুষের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হবে।’
প্রিয়াঙ্কা গান্ধির মতো এত কঠোরভাবে আর কোনও ভারতীয় রাজনৈতিক দল বা নেতা-নেত্রীরা গাজায় বিপন্ন মানবতার পক্ষে আওয়াজ তোলেননি।