পুবের কলম প্রতিবেদক: ক্ষুধা, সংসারের অভাব সব কিছুই নিত্যসঙ্গী। সঙ্গে আছে দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি। তাও নিজের স্বপ্নগুলি দেখতে ভোলেননি বাংলাদেশের পটুয়াখালির বাসিন্দা হাসান পারভেজ। পরম যত্নে সেগুলিকে বাঁচিয়ে রেখে নিজের কাজেই মগ্ন তিনি।
দিনমজুরির কাজ করেন হাসান। তবে একটা বিষয় সবার থেকে আলাদা এই হাসান পারভেজ। ছেঁড়া কাথায় শুয়ে হাসান স্বপ্ন দেখেছেন মানুষের জন্য কিছু করার। আর সেই স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি দারিদ্র্য।
বাংলাদেশের পটুয়াখালির বাসিন্দা হাসান পারভেজ মনেপ্রাণে একজন সাংবাদিক। নিজের হাতেই লিখেই কাগজ প্রকাশ করেন তিনি। হাসানের প্রত্রিকার নাম আন্ধারমানিক। যে সংবাদপত্রের মালিক, সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিক তিনি নিজেই।
হাসান তার পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরেন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কথা। পটুয়াখালির বাসিন্দা হাসান পারভেজ-এর কথায় যাদের কথা শোনার কেউ নেই, তাদের কথা সকলের সামনে তুলে ধরার কাজই করে চলেছেন তিনি। তবে তার জন্য দিনমজুরির কাজে ভাটা পড়েনি তাঁর। সব কাজই তিনি সামলাচ্ছেন সমানতালে।
হাসান একজন দিনমজুরের পাশাপাশি সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। আবার কেউ তাঁকে চেনে কবি হিসেবও।
পটুয়াখালির কলাপাড়া উপজেলায় আন্ধারমানিক নদীর তীরে ছোট্ট গ্রাম পশ্চিম সোনাতলা। সেখান থেকেই হাসান প্রকাশ করে চলেছেন আন্ধারমানিক পত্রিকার একের পর এক সংখ্যা।
জন্ম থেকেই হাসানের নিত্যসঙ্গী দারিদ্র্য। এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল ১৯৯৬ সালে। কিন্তু অর্থ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে হাল ছাড়েননি হাসান। ২০১৫ সালে ফের পরীক্ষায় বসেন। উত্তীর্ণও হন তিনি। স্কুল পেরিয়ে কলাপাড়া সরকারি কলেজে উচ্চ শিক্ষার দিকে এগিয়েছেন তিনি। তবে চলছে প্রত্রিকা ও দিনমজুরির কাজ।
শৈশব থেকে লেখার প্রতি হাসানের ছিল তীব্র ঝোঁক। হাসানের কথায়, কলমই তাঁর প্রাণের আরাম। ‘বাবুরা’ তাই কাজে রাখেন না তাঁকে। কিন্তু তাতে এক দিক থেকে সুবিধাই হয়েছে হাসানের। স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। আর স্বাধীন ভাবে কাজ করবেন বলেই হাসান বেছে নিয়েছেন দিনমজুরি।
হাসান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রত্যন্ত গ্রামে যাদের কথা শোনার কেউ নেই, তাদের কথাই লেখেন তিনি। এই ভাবে লিখতে লিখতেই তাঁর কলমে উঠে এসেছিল ক্লাস থ্রি-য়ে পড়া মেয়ে রুবিনার কথা। রুবিনার মানসিক প্রতিবন্ধী মাকে শিকল দিয়ে বেঁধে বৃদ্ধা ‘নানি’ যেতেন খাবার খুঁজতে। পাহারায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত হত ছোট্ট রুবিনাকে। জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী’ কবিতা অবলম্বনে হাসান আন্ধারমানিক প্রত্রিকায় লেখেন, ‘রুবিনাকে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, তৈয়বআলীর ছোট্ট বাড়ি হোসেনপুরে যাও’।
ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায় হাসানের এই কবিতা। রুবিনার নাম সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। রুবিনা আর্থিক সাহায্য পায়।
এইভাবে আজও একই কাজ করে চলেছেন হাসান পারভেজ। তারই মতো কয়েকজন নেশায় সাংবাদিক কাজ পাগল মানুষ জুটেছে তার। ইটভাঁটা, ধান তোলা কিংবা মাছ ধরার কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা ছুটে যান প্রান্তিক মানুষের কাছে প্রত্যন্ত এলাকায়। তুলে ধরছেন তাদের না বলা গল্প।
গোটা পত্রিকাটি লেখা হয় হাতে। প্রতি মাসে একটি করে সংখ্যা বের হয়। তবে প্রত্রিকায় কোনও সময় নিজের দুঃখের কথা লেখেননি হাসান।
ঘোরতর সংসারী হাসান স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে একটি এক কামরার ঘরে থাকেন। তবে এক চিলতে আশ্রয়ের মালিক তিনি নিজে নন। বাড়িওয়ালা চলে যেতে বললেই চলে যেতে হবে।
তবু সরকারের ঘর দিতে চাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে হাসান জানিয়েছেন, তাঁর তো মাথার উপর ছাদ আছে। অনেকের তাও নেই। দারিদ্র্যের মধ্যেও তিনি তাঁর স্বপ্ন নিয়ে শান্তিতে আছেন। এটাই তার বড় পাওনা। আর বেশি কিছু চান না, বাংলাদেশের পটুয়াখালির বাসিন্দা হাসান পারভেজ।