আহমদ আবদুল্লাহ: দেশে প্রথম দফার ভোট হয়ে যাওয়ার পরই দেশ-বিদেশের সকলেই বুঝতে পারল পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষে এবার ভোটের ইস্যু কী। না না, কারও বিষণ্ণ হওয়ার মতো কিছু নেই। গরিবি, বেরোজগারি, কপড়া, মকান, সড়ক, পানি, বিজলি, ফসল কি কিমত— এসব কিছুই এখন আর ইস্যু নয়। ভারত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি হতে চলেছে। কাজেই এইসব সমস্যা তো এখন তুচ্ছ। ‘বৃহৎ অর্থনীতি’ হয়ে গেলে এইসব যে খুচখাচ সমস্যাগুলি এখনও রয়েছে, তা না হয় দেখে নেওয়া যাবে।
এখন যে ইস্যুতে ভোট হচ্ছে তাহল, ‘হিন্দুসস্থান কা মুসলমান’। একে তো ভারতে এরা কম-বেশি ৮০০ বছর রাজত্ব করেছে। অবশ্য এই রাজত্বে হিন্দুরাও সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকী আওরঙ্গজেব-সহ মুঘলদের সেনাপতিদের অনেকেই ছিল রাজপুত হিন্দু। আর মুসলিম শাসনে হিন্দুদের কখনই দেশের ‘খতরনক সমস্যা’ হিসেবে ভাবা হয়নি। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী ‘জনাব-এ-আলা’ নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি হিন্দুদের কাছ থেকে তা তারা যেই গোত্রের বা জাতপাতের অন্তর্ভুক্ত হোন না কেন, তাদের কাছে মুসলিমদের নামে ভোট চাইছেন। তাঁর দোসর ভাই অমিত শাহও পিছিয়ে নেই। মোদিজির পথ অনুসরণ করে তিনিও মুসলিমদেরই প্রধান ইস্যু হিসেবে প্রচার করেছেন।
অবশ্য মোদি-শাহ জুটির একটি পুরনো খেলা। গুজরাতে মুসলিম বিরোধী জেনোসাইডের সময়ও এমনটিই দেখা গিয়েছিল। আর তারপরেই ভোটে মুখ্যমন্ত্রী মোদি ধীরে ধীরে হয়ে যান দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সহকারী হিসেবে বেছে নিলেন পুরনো সেই সহচরকে।
তা মুসলিমদের কীভাবে মোদিজিরা গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত করলেন? রাজস্থানে ভোট প্রচার করতে গিয়ে অবস্থা বুঝে মোদিকে একটি ঘৃণা ভাষণ দিতে হল। তাতে তিনি বললেন, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোট। এই জোটের লক্ষ্য হল, হিন্দুদের সম্পত্তি, বিশেষ করে ওবিসি, দলিত এদের সম্পত্তি ছিনিয়ে নিয়ে ঘুসপেটিয়া মুসলিমদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দেওয়া! মুসলিমদের চেনার জন্য আর একটি অভিধা তিনি দিলেন, ‘যাদের বাচ্চা বেশি পয়দা হয়’। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদি বলতেন, ‘হাম দো, হমারে দো’। আর মুসলিমদের ক্ষেত্রে তা হল, ‘হাম দো, হমারে পচ্চিশ’। বুঝুন অবস্থা। আর তাই হয়তো গুজরাতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘প্রগম’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর নফরতের এই সওদা করে মোদিজি দিল্লির মসনদ দখল করেছিলেন।
এবারও তিনি সেই পথে হাঁটছেন। ঘুসপেটিয়াদের খুঁজে বের করেছেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ইতিহাস বলে ভারতের মুসলিমদের বেশিরভাগই দলিত, অস্পৃশ্য এবং তথাকথিত নিম্নবর্ণের। তারা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছে। তারা আদি ভূমিপুত্র। কিন্তু হলে কী হবে! মুসলিমদের ইস্যু না করলে সম্ভবত এবার ভোটে উতরানো মুশকিল রয়েছে। তাই তিনি মালদহতে সেই রাজস্থানের ভাষণই পুনরায় উগরে দিয়েছেন। তবে পার্থক্য আছে। তিনি এবার ‘মুসলিম’ শব্দটি খুব একটা ব্যবহার করেননি। বলেছেন ‘ভোট ব্যাঙ্ক’। অবশ্য মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলতেও ভুলে যাননি। তিনি মালদহে গঙ্গার ভাঙন, রেশম শিল্প, শিল্প তালুক গড়া, কৃষির উন্নয়ন, বেরোজগারি হটানো এসব ব্যাপারে খুব বেশি সময় বা শব্দ খরচ করেননি। সবথেকে মজার কথা, ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখতে সাহস না পেয়ে বিজেপি দলের সভাপতি জে পি নাড্ডাকে রাজস্থানের ঘৃণা ভাষণ সম্পর্কে মতামত তলব করেছিল।
সেই জে পি নাড্ডাই শুক্রবার মুম্বইয়ে মোদিজির মতো একই ধরনের ঘৃণা বাক্য ব্যবহার করে ভোট প্রচার করেছেন। আর অমিত শাহ বলেছেন, একটি সম্প্রদায়ের আপত্তি সত্ত্বেও ইউনিফর্ম সিভিল কোড সারা ভারতে লাগু করা হবে। এতে দেশে কোনও বৈচিত্র্য থাকবে না। বোঝা যায়, এক দেশ, এক ভোট, এক নেতা, এক ভাষা ইত্যাদি এই ধরনের ঐক্যের লক্ষ্যে তাঁরা জোরকদমে এগিয়ে যাচ্ছেন।
তাই মুসলিমরাই এখন ভারতের নির্বাচনী প্রচারে প্রধান ইস্যু। অন্তত মোদি-শাহ-নাড্ডা মুসলিমদের ইস্যু করেই ‘বিজয় রথে’ উঠতে চান। তাঁরা আর কোনও ইস্যু পাচ্ছেন না যা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে।
অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলির অবস্থা তথৈবচ। তারা এইসব ঘৃণা ভাষণের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারছে না। কী জানি মুসলিমদের টার্গেট করে যা বলা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে বললে যদি আরও বেশি আক্রমণ আসে, যদি ভোট কাটা যায়! তাই ‘মুসলিম ইস্যু জিন্দাবাদ’। ৪ জুন, ২০২৪ দেখা যাবে মুসলিমরা কোন কোন দলের উপকার করতে পারলেন।