পুবের কলম প্রতিবেদকঃ টানা বর্ষণে রাজ্যের ‘বানডাকানো’ মূল পাঁচটি নদীর জলাধারগুলিতে বর্তমান পরিস্থিতিটা ভয়াবহ। ‘দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভসি) আর সেচ দফতরের সূত্রে পাওয়া তথ্য মোতাবেক– গত ২৪ ঘন্টাযü বন্যা সৃষ্টিকারী দামোদর– অজযü– কংসাবতী– সুবর্ণরেখা– ময়ূরাক্ষী নদীগুলির জলাধারে মোট জল জমা হয়েছে ২ লক্ষ ৮ হাজার ৬৫ একর ফুট আর ওই ২৪ ঘন্টায় ওই জলাধারগুলি থেকে ছাড়া হয়েছে মোট ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৯৭০ একরফুট জল। এই জলে বাংলা ভেসে যাওয়ার কথা নয়। সমস্যা হচ্ছে– ঝাড়খন্ড লাগোয়া এলাকায়ü বাংলার জেলাগুলিতে লাগাতার বৃষ্টিপাত। সেই জলও জলাধারের থেকে ছাড়া জলপ্রবাহে মিশে ডাউনস্ট্রিমের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলছে– বলে জানালেন রাজ্য সেচ দফতরের বাস্তুকার জযüন্ত দাস। তিনি বলেন– যেটুকু তথ্য হাতে পাচ্ছি আসানসোলে কাল থেকে রেকর্ড ৩৪৫ মিমি বৃষ্টি হয়েছে। পাশের বাঁকুড়ার শালতোড়া– গঙ্গাজলঘাটিতে ৩০০ মিমি ও ৩৭২ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেই জল এসে পড়ছে দামোদরে। ফলে চাপ বাড়ছে দুর্গাপুর ব্যারাজে। বৃহস্পতিবার রাত ৮ নাগাদ দুর্গাপুর ব্যারাজের জল ছাড়ার পরিমাণ ছিল ২৩৬ কিউসেক। যা হুগলি– হাওড়া– বাঁকুড়া ও পূর্ব বর্ধমানের একাংশের জন্য বিপজ্জনক। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির প্রায় তিন ডজন ব্লকে লাল সর্তকতা জারি করেছে রাজ্য প্রশাসন। সরিয়ে নিযেü যাওয়া হচ্ছে মানুষজনকেও।
ময়ূরাক্ষী নদীর ম্যাসাঞ্জোর ড্যামের সর্বোচ্চ জলধারণ ক্ষমতা ৩৯৮ ফুট– আর সেখানকার জলের লেভেল ৩৮৫ ফুট ছাপিযেü গেছে। অজযেüর হিংলো জলাধারের বিপদসীমা ৩২৪ ফুট আর জলের মাত্রা ৩১৯ ফুটে পৌঁছে গেছে। দামোদরের তিনটি জলাধার রয়েছে তেনুঘট– মাইথন আর পাঞ্চেৎ। এদের বিপদসীমা যথাক্রমে ৮৬৪– ৪৯৫ ও ৪৩৫ ফুট। সেখানে এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত জলের মাত্রা ৮৫৬– ৪৮৩ এবং ২৬১ ফুটে পৌঁছে গেছে। প্রায় একই অবস্থা কংসাবতী নদীর মুকুটমণিপুর জলাধারের। সেখানে বিপদসীমা ৪৪০ ফুট আর বর্তমানে জলের লেভেল ৪৩৬ ফুটে। সুবর্ণরেখার আপার ড্যামটি রযেüছে জামশেদপুরের কাছে চান্ডিলে। এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানকার জলের মাত্রা ৫৯৪ ফুটে পৌঁছেছে, যার বিপদসীমা ৬৩০ ফুট।
গত ২৪ ঘন্টাযü এই পাঁচটি নদীর জলাধারগুলিতে মোট জমা হয়েছে ২০৮০৬৫ একর ফুট জল আর জলাধারগুলো ছেড়েছে মোট ১৩৬৯৬৯ একর ফুট জল। যার মধ্যে সর্বাধিক জল ছেড়েছে অজযü– যার পরিমাণ ৪১১৫৫ একর ফুট। তবে দামোদরের তিনটি ড্যাম মিলিয়ে সম্মিলিত জল ছাড়ার পরিমাণ ৭০৯১৪ একর ফুট ক্রমশ বাড়ছে বলে দাবি করেন সেচ বিভাগের দামোদর হেডওয়ার্কসের সহকারি বাস্তুকার গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়।
পাশাপাশি টানা তিনদিনের লাগাতার বৃষ্টিতে এবং পাঞ্চেত ডিভিসির ব্যারেজ থেকে জল ছাড়াতে বন্যা হয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলায়। বিশেষত আউশগ্রাম– মঙ্গলকোট– কেতুগ্রাম ব্লকগুলি ক্ষতিগ্রস্ত। সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে অজয় নদের উপকূলে থাকা মঙ্গলকোটে। এই ব্লকের পনেরোটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে এগারোটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অজয় নদের জলে প্লাবিত। ১০৭ টি মৌজার জমি বন্যার জলের তলায় বলে জানিয়েছেন মঙ্গলকোট বিডিও জগদীশ চন্দ্র বারুই। মাঝীগ্রাম– ভাল্ল্যগ্রাম– লাখুড়িয়া এলাকায় অজয় নদের উপকূলীয় বাঁধের একাংশ ভেঙে বন্যার বিপত্তি আরও বাড়িয়েছে। স্থানীয় বিধায়ক অপূর্ব চৌধুরী দুর্গত এলাকাগুলি পরিদর্শনে যান।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার মাঝরাত থেকেই ডিভিসির ছাড়া জল ব্যাপকভাবে ঢুকতে শুরু করেছে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে। কোথাও বাঁধ ভেঙে আবার কোথাও বা বাঁধ উপছে দামোদরের জল ঢুকছে ব্লকে। ইতিমধ্যেই দশটি জায়গায় জল নদীবাঁধ ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে। উদয়নারায়ণপুরে বাসিন্দাদের আশঙ্কা এইবারের বন্যা ভয়াবহ আকার নিতে পারে। অনেকের মতে আটাত্তরের বন্যার ভয়াবহ স্মৃতি ফিরতে চলেছে। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উদয়নারায়ণপুর ব্লকের নটি ও আমতা দুই নং ব্লকের দ্বীপাঞ্চলের দুটি গ্রাম পঞ্চায়েত জলের তলায়। জলের স্রোতের তীব্রতাও অনেক গুণ বেশি। উদয়নারায়ণপুরে উদ্ধার কাজ করছে দুটি কেন্দ্রীয় দুটি রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দল। উদয়নারায়ণপুরে ও আমতা দুই নং ব্লকে সেনা নামানো হয়েছে। উদয়নারায়ণপুর ব্লকের কানুপাট মনসুকাতে সেনা বাহিনীর বানভাসি মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার কাছ শুরু করেছে।
শুক্রবার বিকালের মধ্যেই ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত হযেüছে উদযüনারায়ণপুর ব্লকের রামপুর– ডিহিভুরসুট আসন্ডা– সিংটি– কানুপাট ও হরালি এই পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা। রাতের মধ্যেই ১১ টি গ্রাম পঞ্চাযেüতের মধ্যে খিলা ও হরিশপুর বাদে বাকি সব কটা গ্রাম পঞ্চায়েত প্লাবিত করবে বন্যার জল। ইতিমধ্যে ৮৬ টি স্কুল ও উঁচু বাড়িতে আশ্রয় শিবির করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে ১২টি ফ্লাড সেন্টারের আশ্রয় নিয়েছে মানুষজন।
প্রশাসন সূত্রে খবর শুক্রবার পর্যন্ত উদয়নারায়ণপুরে ১৬ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।