পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: মধ্যযুগীয় বর্বরতা বিহারে। পরপর তিনটি কন্যা সন্তান, পুত্র না হওয়ায় তিন কন্যাকেই শ্বাসরোধ করে হত্যা করলেন মা। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই স্তম্ভিত সকলেই।
বিহারের বক্সার জেলার ব্রহ্মপুর থানার অন্তর্গত গাইঘাট গ্রামে ছেলে না হওয়ার জন্য লাগাতার কটূক্তি সহ্য করতে না পেরে বৃহস্পতিবার রাতে যৌথ পরিবারে বসবাসকারী চল্লিশ বছরের মহিলা পিঙ্কি দেবী তার তিন মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন অভিযোগ। মাত্র তিন দিন আগে গোতিনী (পিঙ্কি দেবীর জা) তার তৃতীয় পুত্রের জন্ম দেন। তার পর থেকেই পিঙ্কির ওপর অত্যাচার আরও লাগামছাড়া হয়ে ওঠে।
এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির “বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও” কর্মসূচির প্রাসঙ্গিকতাকেও তীব্র কটাক্ষ করেছেন বিহারের একাধিক রাজনৈতিক দল। ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী একজন ভালো বাগ্মী। কিন্তু কথার সঙ্গে কাজের বিস্তর ফারাক। বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও নিয়ে ঢালাও প্রচারের কি এটাই ফসল যে একজন মা তাঁর তিন কন্যা সন্তানকে হত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ডুমরাউনের সহকারী পুলিশ কমিশনার শ্রী রাজ জানান, ছেলে না হওয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন পিংকি। পিঙ্কির স্বামী সুশীল যাদব বিহারের বাইরে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করেন এবং যখন এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটে তখন তিনি বাইরে ছিলেন।
পুলিশ পিঙ্কিকে গ্রেফতার করেছে। তার তিন মেয়ে পুনম, (১১) , রনি, (১০) এবং বাবলিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পিঙ্কি প্রথমে দাবি করে তার আত্মীয়রাই মেয়েদের হত্যা করেছে । পরে পুলিশের জেরার মুখে সে ভেঙে পড়ে। স্বীকার করে যে সে নিজেই এই জঘন্য অপরাধ করেছে।
ইউনিসেফ বিহার অফিসের প্রধান নাফিসা বিনতে শফিক বলেন যে ইউনিসেফ বক্সারে তিন মেয়েকে তাদের মায়ের হাতে হত্যার ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি তিনি আরও বলেন, “কোনও অপরাধকে ক্ষমা করা যায় না এবং শিশুদের বিরুদ্ধে এই ধরনের গুরুতর সহিংসতাকে সমর্থন করা যায় না। “প্রত্যেক শিশু সুরক্ষিত এবং নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য ইউনিসেফ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তা বাড়িতে, স্কুলে, সর্বজনীন স্থানে, সর্বত্রই “
সিনিয়র সাংবাদিক তথা ক্রাইম রিপোর্টার সবিতা কুমারী সংবাদসংস্থাকে জানিয়েছেন এই পুরো ঘটনার জন্য সমাজব্যবস্থা দায়ী। “ আমরা কি কোনদিন ভেবে দেখেছি পরপর তিনটি কন্যা সন্তান, পুত্র সন্তান না হওয়ার জন্য ওই মহিলাকে সমাজ ও পরিবারের কাছে কতটা লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা শুনতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। যার ফলে একজন মা বাধ্য হয়েছেন এই চরম সিন্ধান্ত নিতে”
নিজের ক্ষোভ গোপন রাখেননি সাংবাদিক সবিতা, তিনি বলছেন “বক্সার মামলায় পুলিশ তার মেয়েদের হত্যার জন্য মহিলাকে গ্রেপ্তার করেছে ঠিকই কিন্তু যারা তাকে ছেলে না হওয়ার জন্য কটূক্তি করেছিল তাদের কী হবে? শুধুমাত্র কন্যা সন্তান হওয়ার জন্য যারা একজন নারীকে মানসিকভাবে নির্যাতনের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কেন মামলা করছে না? তিনি বলেন, প্রকৃত খুনি তারাই যারা ছেলে না হওয়ার জন্য মাকে কটূক্তি করে।
তিনি বলেন যে এই ধরনের ঘটনা শুধুমাত্র সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের স্থানীয় সংস্করণে কভার করা হয়। সবিতা বলেন যতক্ষণ না একটি মেয়ে কমপক্ষে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষিত হয়, ততক্ষণ তার এই সমাজে টিকে থাকার লড়াইটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়। একজন সাংবাদিকের দৃষ্টিকোন থেকে সবিতার বক্তব্য এরকম কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে কিন্তু কটা প্রকাশ্যে আসছে। হিন্দু সমাজে পুত্রসন্তান হওয়াটা একটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। পুত্রকে দিয়ে বংশরক্ষা হয়। কিন্তু মুসলিম মহিলাদের মধ্যে মেয়ে শিশুকে হত্যার প্রচলন নেই সাফ বলছেন সবিতা।
দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের স্টেট কোঅর্ডিনেটর শাহিনা পারউইন বলেন যে আজও আমাদের সমাজ এটা মেনে নিতে পারেনি যে কন্যারাও পরিবার ও সংসার চালাতে সক্ষম। শাহিনা বলছেন “পিঙ্কি যা করেছেন তা তার ছেলে না হওয়ার জন্য প্রচন্ড পারিবারিক চাপে দমবন্ধ অবস্থার বহিঃপ্রকাশ।”
তিনি বলেছিলেন যে নির্ভয়া মামলার পরে বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও একটি স্লোগানে পরিণত হয়েছিল কিন্তু “একটি সিদ্ধান্ত দরকার যে প্রতিটি শিশুকন্যার সম্পূর্ণ লালনপালন সরকারের দায়িত্ব হয়ে উঠবে। এর ফলে সমাজে মেয়েদের বোঝা মনে না করার জন্য স্বস্তির অনুভূতি তৈরি হবে।”
শুধুমাত্র স্লোগান গার্হস্থ্য সহিংসতা কমাতে সাহায্য করে না। একটি শিশুকন্যার জন্মের পর আত্মীয়, সমাজ সকলের মধ্যে সচেতনার উন্মেষ ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। না হলে আরও পিঙ্কি যাদবের ঘটনা সামনে আসবে।
আমাদের সমাজকে অবশ্যই মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সরকারকে অবশ্যই বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করতে হবে, একটি নিরাপদ বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে এবং এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে বাড়ির ভিতরে বা বাইরে মেয়েদের বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতা না হয়।” সরকারকে শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য ঘোষণা করা উচিত নয়, বাস্তবায়নও নিশ্চিত করা উচিত।