সামনের ৩০ সেপ্টেম্বর ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচন। তৃণমূলনেত্রীর বিরুদ্ধে বিজেপি এবং সিপিএম প্রার্থীর ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস দিয়েছেন জয়ন্ত সিংহ।
এক পক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সর্বভারতীয় নেত্রী– যিনি শুধু একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই নন– কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে দেশজোড়া যে জোট হতে চলেছে– তাঁর অবিসংবাদিত নেত্রী– এই মুহূর্তে যাঁর জনপ্রিয়তার পারদ তুঙ্গে। অন্যপক্ষে দু’টি দলের দুই প্রার্থী। যে সিপিএম সদ্য হয়ে যাওয়া বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়েও একজন বিধায়ককে জেতাতে পারেনি– সেই সিপিএমের এক তরুণ প্রার্থী আইনজীবী শ্রীজীব ঘোষ। আর বহু শলাপরামর্শের পর বিজেপি প্রার্থী করেছে এক তরুণী আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়ালকে– যিনি গত বিধানসভায় এন্টালি কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ৩০ সেপ্টেম্বর ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। তৃণমূল প্রায় লড়াই করে নির্বাচন কমিশনের থেকে এই কেন্দ্রের উপনির্বাচনের নির্ঘণ্ট আদায় করে এনেছে। কমিশন এই কেন্দ্রে উপনির্বাচন ঘোষণার পাশাপাশি আরও তিন কেন্দ্রে উপনির্বাচন ঘোষণা করেছে ওই একই দিনে। কিন্তু সেই তিন কেন্দ্র ছাপিয়ে ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী বলেই সারা দেশের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কেন্দ্র।
সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে মমতা পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন। তবে এই পরাজয় সন্দেহমুক্ত নয়। স্বভাবতই এই নিয়ে মামলাও হয়েছে এবং তা বিচারাধীন। নন্দীগ্রামের ভোট নিয়ে তিনটি প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি। ১) গত ২ মে নন্দীগ্রামে ফল ঘোষণার দিন শেষমুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিজয়ী ঘোষণা করেও আচমকা কেন বলা হয় শুভেন্দু অধিকারীর জয়ের কথা? ২) এত হাই ভোল্টেজ নির্বাচনে তাঁকে বিজয়ী ঘোষণার পর প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে যান শুভেন্দু অধিকারী। তিনদিনের মতো তিনি নিরুদ্দেশ থাকার পর আত্মপ্রকাশ করেন। ‘এত বড় জয়’- এর পরও কেন জবরদস্ত বিজয় মিছিল করা হল না নন্দীগ্রামে?৩) গণনাকেন্দ্রের এক সরকারি আধিকারিক কেন হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুকে জানালেন যে বন্দুকের নলের মুখে কাজ করতে হচ্ছে?
ভবানীপুর কেন্দ্রে গত নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী হয়েছিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এবং তিনি বিজেপির তারকা প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষকে ২৮ হাজারেরও বেশি ভোটে পরাজিত করে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। গত নির্বাচনগুলিতে বারবার এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীরাই সহজেই জয়ী হয়েছেন। অর্থাৎ এই আসনে তৃণমূলের জয় অবশ্যম্ভাবী। ভবানীপুর কেন্দ্রটি জনসংখ্যার বিচারে কসমোপলিটন অঞ্চল। একসময়ে এখানে কয়েক লক্ষ গুজরাতি থাকতেন। তাঁদের বৃহদাংশ নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু অবাঙালি ভোটার সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে গত এক দশকে। এই অবাঙালি ভোটাররাই বিজেপির টার্গেট এবং ভরসা। সেই কারণে বিজেপি ভাটপাড়া থেকে অর্জুন সিং এবং হাওড়া থেকে সঞ্জয় সিংকে এনে ওখানে ভোট পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে।
বিজেপি বরাবরই মনে করে পশ্চিমবঙ্গে অবাঙালি ভোট তাদের সম্পত্তি গোছের। সত্যিই তা হলে বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনে যে আসনগুলিতে জিতেছে তার চেয়ে অনেক বেশি আসনে জিততে পারত। যে সঞ্জয় সিং হাওড়া থেকে ভবানীপুরে ভোট করতে গিয়েছেন তিনিই মধ্য হাওড়া কেন্দ্রে প্রার্থী হয়ে অবাঙালি ভোট তেমন পাননি এবং বিপুল ভোটে হেরে গিয়েছেন মন্ত্রী অরূপ রায়ের কাছে। কারণ অবাঙালিরা মনে করেন– এ-রাজ্যে তাঁরা বেশ সুখে-শান্তিতে রয়েছেন। এই প্রতিবেদকের ঘরের পরিচারিকার কাজ করেন যে অবাঙালি মহিলা তাঁর তিন মেয়েই অনলাইনে পড়াশোনা করার জন্য মোবাইল কেনার ১০ হাজার করে টাকা পেয়েছে। একজন কলেজে ভর্তি হয়েছে– অন্যরা কাজও করছে– পড়াশোনাও করছে। ওই পরিচারিকার বাড়ি উত্তরপ্রদেশের গ্রামে। ও বলে– ‘ইউপিতে থাকলে তিন মেয়েকেই এতদিনে গুণ্ডারা তুলে নিয়ে চলে যেত। এখানের মতো শান্তি কোথাও নেই।’ এই রাজ্যে প্রথম হিন্দি কলেজ হয়েছে মমতারই আমলে এবং হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ও হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। তাই অর্জুন সিংরা রাত জেগে কাজ করে গেলেও ভবানীপুরে ভোটের ভবিতব্যকে বদলাতে পারবেন না। মমতা শোভনদেবের চেয়ে অনেক বেশি ভোটে এই কেন্দ্র থেকে জিতবেন। সিপিএম এবং বিজেপিও সেটা বিলক্ষণ জানে। কিন্তু নেহাত প্রার্থী না দিলে ইজ্জত চলে যাবে। তাই প্রার্থী দিতে হয়েছে।
বিজেপি যেখানেই ভোট চাইতে যাবে, কেন গ্যাসের সব ভরতুকি তুলে নেওয়া হল– কেন পেট্রোল-ডিজেলের দাম আন্তজার্তিক বাজারে সবচেয়ে সস্তা হওয়া সত্ত্বেও এদেশে শুধু বেড়েই চলেছে– কেন করোনা ভ্যাকসিন পাচ্ছেন না মানুষ– অতিমারিতে কর্মহীনদের কেন অন্য দেশের মতো ভাতা দিচ্ছে না কেন্দ্র এমন হাজারো প্রশ্নের মুখে পড়বে। প্রকৃতপক্ষে এইসব প্রশ্নের কোনও জবাব নেই তাদের কাছে। রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে প্রায় তুলে দেওয়া হচ্ছে। লাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৯৯ বছরের লিজে দেবে সরকার। রক্ত দিয়ে ঘাম ঝরিয়ে স্বাধীনতার পর ভারতবাসী যেসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে তার প্রায় সবই লিজে দেওয়ার নামে বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্র। ৯৯ বছরের লিজ তো বিক্রিরই সমান। তাই যুক্তিগতভাবে বিজেপির ভোট চাইবার কোনও অবকাশ নেই। শুধু নেতিবাচক কথা বলে ভোটে লড়া যায় না।
অন্যদিকে– সিপিএমের রাজনীতির জমি কেড়ে নিয়েছেন কুশলী রাজনীতিক মমতা। সিপিএম এবং বামেরা সাধারণত গরিব মানুষের মানোন্নয়নের দাবি তুলেই রাজনীতির জমি পোক্ত করেছিল। গত এক দশক ধরে মমতা তাঁর দলকে সেই লক্ষ্যেই চালিত করে তৃণমূলকে বামপন্থী দলে পরিণত করেছেন। তাঁর বেশিরভাগ প্রকল্পই গরিব মানুষের হিতার্থে। তাই বামেরা কী দাবি তুলবে ভেবে পাচ্ছে না। এক কথায় বামেরা দিশাহারা। সাবেক কংগ্রেস আমলে জমিদারি মেজাজে মন্ত্রিত্ব করতেন মন্ত্রীরা। অন্যদিকে মমতা তাঁর মন্ত্রীদের সর্বক্ষণ পরিশ্রম করান। সিপিএম ইদানীং ভোটে প্রার্থী দেওয়ার সময় তরুণদের তুলে আনে। ভোট শেষ হলেই তাঁদের ‘পুনর্মুষিক ভব’ করে দেয়। ফের বৃদ্ধদের রাজত্ব চলে। নন্দীগ্রামে মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায়কে মমতার বিরুদ্ধে প্রার্থী করে যখন সিপিএম নেতারা দেখলেন মীনাক্ষি ভালো প্রচার পেয়ে উঠে পড়ছে– তাঁকে ফের ‘পুনর্মুষিক ভব’ করে দিয়েছে। অন্যদিকে মমতা বারবার তরুণদের তুলে আনছেন।
আর নন্দীগ্রামে ৩৮ শতাংশ মুসলিম ভোট ছিল বলে যে মেরুকরণের কাজ করা হয়েছিল— তা ভবানীপুরে সম্ভব নয়। এখানে ভোটদাতাদের সংখ্যাবিন্যাস ভিন্নরকম। তাই সব দিক বিচার করে ভবানীপুর কেন্দ্রে মমতার রেকর্ড ভোটে জয় স্রেফ সময়ের অপেক্ষামাত্র। মমতা কোনও প্রচার না করলেও নিশ্চিত জয়ী হবেন।