পুবের কলম প্রতিবেদক: বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত ছবি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ এ বছর মার্চ মাসে মুক্তি পাওয়ার পরপরই এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। এটিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মন্তব্য করেছিলেন ফিল্ম বোদ্ধারা।
সিনেমাতে যেভাবে নব্বইয়ের দশকে কাশ্মীর থেকে পণ্ডিত বিতাড়ন ও নির্যাতনের চিত্র দেখানো হয়েছে তা আসলে উপত্যকার বর্তমান পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলবে বলে তারা মত দিয়েছিলেন। মাসখানেক পর ঠিক সেটাই ঘটেছিল। বেশ কয়েকজন কাশ্মীরি পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়। মোদি-অমিত শাহের সরকার তাদেরকে জঙ্গিদের হাত থেকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। ছবি বানিয়ে পণ্ডিতদের পাশে আছি, এমন ভাব দেখালেও প্রয়োজনের সময় সমর্থন ও সহযোগিতা পায়নি পণ্ডিতরা। সেখানে কাশ্মীরি মুসলিম ও হিন্দু পণ্ডিতরা শান্তিতেই বসবাস করছিল।
সিনেমা সেই সম্পর্কের পুরনো ক্ষত খুঁচিয়ে তোলে। তাই ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ দেশে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সিনেমা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই একই সুর এবার শোনা গিয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র পরিচালক নাদাভ লাপিদের মুখে।
গোয়ায় আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্ডিয়ার মঞ্চে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিকে ‘অশ্লীল’ ‘একপেশে’ প্রোপাগান্ডামূলক ছবি বলে তীব্র ভর্ৎসনা করেন চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি চেয়ারম্যান নাদাভ লাপিদ। ইসরাইলি পরিচালক জুরির এই মন্তব্য ঘিরে এখন ফের চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে এই ছবি।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে ছবিটি অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত তাঁকে ‘বিস্মিত’ এবং ‘বিচলিত’ করেছে বলেও নাদাভ লাপিদ জানান। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরার পুরস্কার জয়ী খ্যাতনামা এই ইসরাইলি পরিচালক এও জানান, ছবিটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে শুনে তিনি অবাক হয়েছেন।
এমনকী আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর প্রদর্শনে জুরির বাকি সদস্যরা ‘অসন্তুষ্ট এবং হতবাক’ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন নাদাভ। তিনি বলেন, ‘প্রতিযোগিতায় থাকা ১৫টি ছবির মধ্যে ১৪টির শিল্পগুণ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু পঞ্চদশ সিনেমা ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’কে আমি প্রপাগান্ডামূলক এবং আপত্তিকর একটি ছবি বলেই মনে করছি। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতায় এই ছবিকে রাখাটাই ঠিক হয়নি।’
কেন্দ্রীয় তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এবং কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী এল মুরুগানের উপস্থিতিতেই ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে খোলাখুলি মন্তব্য করেন ইফির জুরি চেয়ারম্যান।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সিনেমাটির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। সেই সিনেমা নিয়ে এমন মন্তব্য করতেই শুরু হয় তীব্র রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন। এর প্রেক্ষিতে নাদাভের মন্তব্যের সমালোচনা করেন ভারতে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত নায়োর গিলন।
নাদাভের সমালোচনায় একটি খোলা চিঠি লেখেন ভারতে নিযুক্ত ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত। এতে নায়োর গিলন ভারতের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং বলেছেন যে ভারতের আতিথেয়তা এবং বন্ধুত্বের বিনিময়ে লাপিদের এমন বিবৃতি দেওয়ার জন্য আমি লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
কেন্দ্রের মোদি সরকারের চাপে পড়েই ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছেন বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। ছবির পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী লাপিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেছেন, সব সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, আরবান নকশাল এবং যারা ভারতকে টুকরো টুকরো করতে চায় তারা সব সময়ই এ ধরনের মন্তব্য করছে ছবিটি নিয়ে।
ছবির অভিনেতা অনুপম খের বলেন, ‘কিছু মানুষের সত্যিটাকে সত্যির মতো দেখার বা দেখানোর অভ্যাস থাকে না। তা নিজের মতো করে রং দিয়ে, সাজিয়ে দেখতে চান। শিবসেনা লাপিদের জন্য ইসরাইলি রাষ্ট্রদূতকে যেভাবে ভার্চুয়াল আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে, তার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
অপরদিকে পিডিপির সিনিয়র নেতা নাইম আখতার বলেন, এই সিনেমা পণ্ডিতদের জীবনে ভালো কিছু বয়ে আনতে পারেনি। এর মাধ্যমে ভারতের করুণ চিত্রই ফুটে উঠেছে। তবে বিজেপিও ময়দান ফাঁকা ছেড়ে দেয়নি। তাদের মুখপাত্র অমিত মালব্য ক্ষোভের সঙ্গে জানিয়েছেন, হলোকাস্টকেও প্রথমে স্বীকার করা হত না এবং একে প্রপাগান্ডা বলত। কিন্তু মানুষ একসময় ঠিকই এর ভয়াবহতা বুঝেছে। কাশ্মীর ফাইলসকেও প্রপাগান্ডা বলা হচ্ছে।
বলিউড অভিনেত্রী স্বরা ভাস্কর একটি ট্যুইট বার্তায় নাদাভকে তার সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি ট্যুইট করার সঙ্গে সঙ্গে নেটিজেনরা অভিনেত্রীকে ট্রোল করতে শুরু করেন।
অনুপম খের, মিঠুন চক্রবর্তী, দর্শন কুমার এবং পল্লবী যোশি অভিনীত এই ছবিটি মুক্তির পর থেকেই দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়। এমনকী দেশের বেশকিছু বিজেপি শাসিত রাজ্যে কাশ্মীর ফাইলসকে করমুক্ত করেও দেওয়া হয়।
পরিচালকের দাবি, ১৯৯০ সালে কাশ্মীর উপত্যকায় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর হওয়া অত্যাচার ও উপত্যকা ত্যাগের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে এই ছবি। তবে ছবির দর্শক ভাগ হয়ে গিয়েছিল দুই ভাগে। একদলের কাছে দারুণ প্রশংসা পেলেও অন্য দলের থেকে চরম নিন্দা জুটেছে।
বিজেপির তাঁবেদারি করা সিনেমা বলেই মন্তব্য করেছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ তীব্র ঘৃণা উগরে বলেছেন, অসত্য প্রচার করে দেশের মানুষকে বিভ্রান্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে বিজেপি। আবার অনেকেই বলেন যে, দ্য কাশ্মীর ফাইলস গোটা দেশে ঘৃণার আবহ তৈরি করছে। শুধু তাই নয়, কাশ্মীর ফাইলসে যা দেখানো হয়েছে, তা অর্থহীন। পুরোপুরি মিথ্যার উপর ভিত্তি করে এই ছবি তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।