পুবের কলম প্রতিবেদক: কর্নাটকের উদুপির পিইউ কলেজের মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরার অধিকার চেয়ে একাধিক আবেদন মঙ্গলবার খারিজ করে দিল কর্নাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ঋতুরাজ অবস্থির নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ। মুসলিম ছাত্রীদের আর্জিতে আবেদন জানানো হয়েছিল যেহেতু হিজাব ইসলাম ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ, তাই তাদের ইউনিফর্মের উপর হিজাব পরে ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হোক। এই মামলাগুলির দীর্ঘ ১১ দিনের শুনানি চলাকালীন বাদীপক্ষের আধডজন আইনজীবী সওয়াল করতে গিয়ে পবিত্র কোরান এবং হাদিসের আলেমে আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে হিজাব পরার অমোঘ নির্দেশ রয়েছে ইসলাম ধর্মে। কিন্তু বেঞ্চ আইনজীবীদের যুক্তি খারিজ করে দিয়ে তাদের রায়ে বলেছে, আদালত মনে করে মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরা ইসলাম ধর্মে কোনও আবশ্যিক নিয়ম নয়। তাই আদালত মনে করে স্কুলে ইউনিফর্ম পরার নির্দেশ সঠিক এবং তা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। এই মামলার শুনানি চলছিল কর্নাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ঋতুরাজ অবস্থি, বিচারপতি কৃষ্ণ এস দীক্ষিত এবং বিচারপতি জেএম কাজীর বেঞ্চে।
এদিন কর্নাটক হাইকোর্ট তাদের রায়ে সরকারের ৫ ফেব্রুয়ারী নির্দেশকেও সঠিক বলেছে যেখানে বলা হয়েছিল যেসব কলেজে ইউনিফর্ম পরার নির্দেশ রয়েছে, সেখানে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা যেতেই পারে। আদালত বলছে, তারা এই মামলাগুলি বিবেচনা করতে গিয়ে তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে এবং তার আইন উত্তর দিয়েছে। প্রথম প্রশ্ন হল, হিজাব কি ইসলাম ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ? আদালত মনে করেছে, ইসলাম ধর্মে হিজাবকে ‘আবশ্যিক’ করা হয়নি। তাই হিজাব নিষিদ্ধ করলে সংবিধানের ২৫ নং ধারা (ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার) ভঙ্গ হবে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল স্কুলে ইউনিফর্মের প্রচলন কি সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ নং ধারার এবং ২১ নং ধারার (ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা ও মতপ্রকাশের অধিকার) পরিপন্থী। আদালত মনে করে, স্কুলে ইউনিফর্মের প্রচলন আদৌ সংবিধানের উক্ত ধারাগুলির বিরোধিতা করে না। তৃতীয় প্রশ্ন হল, সরকারি নির্দেশে যে ইউনিফর্ম পরার কথা বলা হয়েছিল, সেটি কি বেআইনি। আদালত মনে করে সরকারি নির্দেশ আইন মেনেই পাঠানো হয়েছিল। এই সব কারণে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরার অধিকার সংক্রান্ত মামলাগুলি খারিজ করে দেওয়া হল বলে এ দিন তাদের রায়ে জানিয়েছে কর্নাটক হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ।
কর্নাটক হাইকোর্টের রায় এদিন আসার পর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনস তনবীর বলেছেন, তিনি মুসলিম ছাত্রীদের পক্ষে এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানাব সুপ্রিম কোর্টে। কারণ আমার মতে কর্নাটক হাইকোর্টের রায় ‘ভ্রান্ত’ এবং ‘হতাশাজনক’। রায়ে আইনের সঠিক ব্যাখ্যা করা হয়নি বলে আমি মনে করি। এখানে প্রশ্ন এটা নয় যে হিজাব ইসলাম ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ কি না। এখানে প্রশ্ন হল কর্তৃপক্ষ কি হিজাব নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দিতে পারে। বর্তমানে দেশে স্কুল ইউনিফর্ম সংক্রান্ত কোনও কেন্দ্রীয় সরকারের আইন নেই। কিন্তু কর্নাটক হাইকোর্টের রায়ের পর বহু রাজ্য এবং হিজাব এবং ইউনিফর্ম সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করতে তৎপরতা দেখাবে। ফ্রেটারনিটি মুভমেন্ট নামক সংস্থার এক ছাত্রী কর্মী আফরিন ফাতিমা মনে করেন, হাইকোর্টের রায় খুবই ‘দুশ্চিন্তাজনক’।
এই রায় আসলে আইনত বর্ণবৈষম্যকে উৎসাহিত করবে। এই রায় মুসলিম মেয়েদের শিক্ষা পরিসর থেকে আরও বাইরে ঠেলে দেবে। এরপর উৎসাহিত হয়ে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম মহিলাদের প্রকাশ্য সড়কপথে হেনস্থা শুরু করবে। ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার কর্নাটকের রাজ্য সম্পাদক সঈদ সরফরাজ আদালতের রায়কে ‘অসাংবিধানিক’ বলেছেন। কর্নাটকের বহু উদারপন্থী হিন্দু মনে করেন, ইতিহাসের আলয়ে দেখলে প্রকাশ্যে হিজাব কোনওদিন ভারতে নিষিদ্ধ হয়নি। বহুদশক ধরেই মুসলিম মেয়েরা স্কুল, কলেজে হিজাব পরে আসা-যাওয়া করছেন, ঠিক সেভাবেই যেভাবে হিন্দু- শিখ- খ্রিস্টান তাদের ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করে থাকেন। সরফরাজ বলেন, আদালত বলেছে ইসলামে নাকি হিজাব আবশ্যিক নয়। এটি শুনে আমি হতভম্ব। এটা আদালত ঠিক করার কে? হিজাব যে আবশ্যিক, সেটা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পবিত্র কোরানেই বলা হয়েছে। কর্নাটকের প্রাক্তন এমএলসিসি এম ইব্রাহিম যিনি সম্প্রতি কংগ্রেস ত্যাগ করেছেন, তিনি এ দিন বলেন, তারা হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। তিনি ইতিমধ্যেই মুম্বইয়ে আইনজীহীদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মুসলিমদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা রায়ের বিরোধিতা করে কেউ পথে নামবেন না।
বিরোধী দল নেতা সিদ্ধারামাইয়া বলেছেন, ইউনিফর্মের সঙ্গে হিজাব পরলে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও বলেছেন, কে কী পরবে তা নিয়ে সরকার মাথা ঘামাবে কেন। কেন হিজাবকে নিয়ে উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে। কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ে আমি খুবই হতাশ। হিজাব শুধু একটি কাপড়ের টুকরো নয়, মেয়েরা কী পরবে, সেটা তাদের অধিকার। প্রসঙ্গত, হিজাব বিতর্ক শুরু করে কিছু হিন্দুত্ববাদী যুবক যাদের হাতে হেনস্থা হতে হয়েছে বহু হিজাব পরিহিতা মুসলিম ছাত্রীদের। মহিলা জাতীয় কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই বলেছেন, যারা রায়ের পর রাজ্যে শান্তিভঙ্গের চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনজীবী ইন্দিরা জয় সিং বলেছেন, এই রায় সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিল। কংগ্রেসের পূর্ণমন্ত্রী তনবীর সেইট বলেছেন, রায়কে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানানো হবে।