আহমদ হাসান ইমরান: ফিলিস্তিনের গাজায় এবং কিছুটা কম হলেও পশ্চিম তীরে ইসরাইলের গণহত্যা তীব্রভাবে জারি রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে মুসলিমদের এই গণহত্যায় উৎসাহ দাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধু মারাত্মক অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য নয়, অনেকে বলছেন, মার্কিন সেনারাও বিশেষ করে নৌবাহিনীর কমান্ডোরা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে।
তাদের লক্ষ্য, ‘পোষ্যপুত্র’ ইসরাইলের পশ্চিম এশিয়ায় আধিপত্য বজায় রাখা এবং তার জন্য গাজার কয়েক লক্ষ মানুষকে সরাসরি কিংবা খাদ্য, পানীয়, ওষুধ এবং আশ্রয়ের অভাবে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে আগ্রহী।
শুক্রবার জুম্মার দিনও ইসরাইলি খুনী বাহিনী গাজায় তীব্র আক্রমণ চালিয়েছে। তারা গাজার পুরনো শরণার্থী ক্যাম্প-সহ বিভিন্ন এলাকায় কার্পেট বম্বিং করে চলেছে। অবরুদ্ধ গাজায় কোনও ত্রাণ সামগ্রী ইসরাইল প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। ফলে গাজায় প্রায় ৬ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ অনাহারে মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এসব নিয়ে শান্তি ও মানবাধিকারের প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগী দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির কোনও হেলদোল নেই।
গাজায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলির আচরণ প্রমাণ করে দিয়েছে, যেসব কথা বলা হয় যেমন শান্তি, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌমত্ব, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এইসব শুধু তাদেরই জন্য কিংবা বলা যায়, এগুলি হল তাদের কাছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলিকে পুরোপুরি দমিয়ে রাখার হাতিয়ার মাত্র। বাস্তবে এগুলির কোনও মূল্যই নেই। মানুষের জীবনের কোনও দাম তাদের কাছে নেই। তবে তাদের একজন নাগরিককেও যদি কেউ হত্যা করে কিংবা তার উপর হামলা চালায়, তবে তা নিয়ে তারা আকাশ-পাতাল মথিত করে তোলে।
আর রাষ্ট্রসংঘকে এই পশ্চিমা দেশগুলিই অচল ও ক্রীড়নকে পরিণত করেছে। এর কোনও মূল্য আজ নেই। এর মধ্যে শুক্রবার আমেরিকা-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নরসংহারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। সবথেকে বড় বিক্ষোভটি হয়েছে ইয়েমেনে। এখন গাজায় অধিকাংশ শিশু, নারী-সহ নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়ে প্রায় ২১,০০০।
আর আহতের সংখ্যা প্রায় ৫৩,০০০ বলে সমস্ত সংবাদমাধ্যম উল্লেখ করেছে। এদের বেশির ভাগই গুরুতরভাবে জখম। বেঁচে থাকলে অনেকেই সারা জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যাবে। সবথেকে বড় কথা, চিকিৎসার কোনও সুবিধায়ই এই মানুষগুলির হাতে পৌঁছাচ্ছে না। ইসরাইলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণে গাজার সমস্ত হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে। আর যে দু-একটি এখনও বেঁচেবর্তে আছে তাতে জরুরি ওষুধ ও অন্য সরঞ্জাম নেই।
নিরাপত্তা পরিষদের পুনরায় বৈঠক হওয়ার কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়ে রেখেছে ইসরাইলের মনোবাঞ্ছার বিরুদ্ধে কোনও প্রস্তাব আনা হলে তাতে তারা আগের মতোই ভেটো প্রয়োগ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু রাজি হয়েছে যে, গাজায় সব ধরণের ‘মানবিক সাহায্য’ যাতে পৌঁছায়, নিরাপত্তা পরিষদ এই ধরনের কোনও প্রস্তাব নিক।
তাতে তারা সমর্থন দেবে। (যা লিখেছিলাম শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। মার্কিন চাপে নিরাপত্তা পরিষদে একটা দায়সারা প্রস্তাব পাশ হয়েছে। বলা হয়েছে, গাজায় মানবিক ত্রাণ সাহায্য পাঠানো উচিত। যুদ্ধ বন্ধের কোনও কথা এই প্রস্তাবে নেই। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নিরাপত্তা পরিষদ শেষ পর্যন্ত যে প্রস্তাব পাশ করেছে, তা অর্থহীন। এর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, আদৌ হবে কী না সে সম্পর্কে কোনও দিশাই নেই।)
অর্থাৎ যুদ্ধ, বোমা বর্ষণ, নরসংহার এবং ধ্বংস প্রক্রিয়া জারি থাকবে। শুধু গাজায় খাবার দাওয়ার, ওষুধ পাঠানো হবে। কিন্তু যুদ্ধ না থামলে কারা এগুলি ব্যবহার করবে, কী করে ব্যবহার করবে তার কোনও হদিশ তারা দিতে পারছে না।
গাজা যুদ্ধের একটি অন্যদিকও রয়েছে। ইসরাইল কিন্তু ব্যাপক আর্থিক, বাণিজ্যিক ক্ষতি এবং খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়েছে। প্রথমে প্রশ্ন, কতজন ইসরাইলি সৈন্য নিহত হয়েছে। এখন প্রতিদিনই ৪০-৫০ জন করে ইসরাইলি সৈন্যের মুখোমুখি যুদ্ধে নিহত হওয়ার খবর আসছে।
এছাড়া হামাসের আল কাসেম ব্রিগেড জানিয়েছে, তারা প্রায় ৭০০-র বেশি ইসরাইলি সাঁঝোয়া গাড়ি এবং ১৫০-এরও বেশি ইসরাইলি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে। শুধু তাই নয়, এর ছবিও আল কাসেম ব্রিগেড প্রকাশ করেছে। একটি সাঁঝোয়া গাড়িতে কম করে ১০-১২ জন সেনা থাকে। আর ট্যাঙ্কেও থাকে ৬-৭ জন সেনা।
হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, ইসরাইলি সেনার মৃত্যু কম হলেও ৭০০০-এর বেশি। আহতের সংখ্যাও প্রচুর। যারা ইসরাইলি কবরস্থান এবং হাসপাতালের খবর রাখছেন তাঁরা বলছেন, আহত ও নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। সবথেকে বড় কথা, এখনও ইসরাইল ছোট্ট একটি সংগঠন হামাসকে পরাজিত করতে পারেনি। এখনও হামাস রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে যাচ্ছে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে।
আর গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, ইসরাইলের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার মুখে।
ইসরাইলের মালামাল আদান প্রদানেও একমাত্র রাস্তা হচ্ছে সমুদ্রপথ। দেখা যাচ্ছে, ইয়েমেন লোহিত সাগরে ইসরাইলের বা ইসরাইলমুখী জাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পর বহু জাহাজ কোম্পানি ইসরাইলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে লোহিত সাগর দিয়ে ইসরাইলে কোনও মালামাল বা জিনিসপত্র আসা এবং যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।
আমেরিকা এই পথ খোলার জন্য বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে একটি জোট গড়তে চাইছে। কিন্তু ওই মিত্র দেশগুলির অনেকে বলে দিয়েছে তারা এই জোটে অংশ নেবে না। আরব দেশগুলি ইয়েমেনের ক্ষেপণাস্ত্রের ভয়ে এই জোটে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রয়েছে। ইসরাইলের আর একটি সমুদ্রপথ ছিল মালয়েশিয়া হয়ে মালাক্কা প্রণালী।
কিন্তু মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছেন, আমরা মালয়েশিয়ার সমুদ্রপথ দিয়ে ইসরাইলি জাহাজের আনাগোনা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলাম। ফলে ইসরাইল এখন খাদ্য ও পেট্রোল সংকট, বর্হিবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার সংকটে পড়েছে।
নেতানিয়াহুর নানা ধরনের হুংকার সত্ত্বেও ইসরাইল এখন গাজার যুদ্ধে গভীর সমস্যা ও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ ইহুদিরা যুদ্ধ বিরতি চাইছে। ইসরাইলের এখন একমাত্র ভরসা আমেরিকা। সেই আমেরিকাতেও সাধারণ মানুষ গাজার উপর এই নির্মমতা এবং বর্বরতা বন্ধ করার জন্য বিক্ষোভ শুরু করেছে। তাই গাজা যুদ্ধ ইসরাইলের পতন ডেকে আনছে কী না তা আগামীতে দেখার বিষয়।