বিশেষ প্রতিবেদক: ভারতের পত্রপত্রিকায় একটি খবর একইসঙ্গে দুঃখ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। খবরটি হল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত ইসকন রাধাকান্ত মন্দিরে বৃহস্পতিবার হামলা হয়েছে।
খবরটি সংবাদ-সংস্থা এএনআই থেকে দ্য হিন্দুস্থান টাইমস নিয়েছে বলে উল্লেখ করে ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ সেটি উদ্ধৃত করেছে। সেইসঙ্গে ইন্ডিয়া টুডেও একই দুঃখজনক খবর পরিবেশন করেছে। ইসকন মন্দিরে কলকাতায় স্থিত ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমণ দাস ট্যুইটারে যে বক্তব্য দিয়েছেন, প্রায় সবগুলি গণমাধ্যম তা উদ্ধৃত করেছে। শ্রীরাধারমণ দাস লিখেছেন, হিন্দুদের উচিত হবে রাষ্ট্রসংঘের মতো নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলির উপর ভরসা না করা। কারণ তারা হিন্দুদের আর্তনাদেও নীরব থাকে। ইসকনের এই নেতা আরও বলেছেন, ‘দোলযাত্রা ও হোলি উৎসবের ঠিক আগে খুবই এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। মাত্র কিছুদিন আগে রাষ্ট্রসংঘ ইসলামফোবিয়াকে রোখার জন্য ১৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে প্রস্তাব পাস করেছে। আমরা খুবই বিস্মিত, সেই রাষ্ট্রসংঘ হাজার হাজার অসহায় বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানি সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনে নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। অসংখ্য হিন্দু সংখ্যালঘু তাদের প্রাণ হারিয়েছেন, সম্পত্তি হারিয়েছেন, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু হায়, রাষ্ট্রসংঘ শুধু ইসলামফোবিয়া নিয়েই চিন্তাভাবনা করছে।’
ইসলামফোবিয়া রোখার জন্য রাষ্ট্রসংঘ প্রস্তাব পাস করায় ইসকনের নেতা যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তা তিনি রাখঢাক না রেখেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ইসকনের কলকাতা-স্থিত ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমণ দাস আরও বলেন, প্রায় ২০০ জনের এক উৎশৃঙ্খল জনতা ইসকন মন্দিরে ভাঙচুর ও লুঠ করে। এই ঘটনা বাধা দিতে গেলে ইসকনের তিনজন কর্মী আহত হন। তবে তাদের কারও অবস্থাই গুরুতর নয়। শ্রীরাধারমণ দাস বলেন, বাংলাদেশি প্রশাসন এবার খুবই দ্রুত ব্যবস্থা নেয় এবং বিরাট সংখ্যক পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। শ্রী শ্রী রাধারমণ দাস ইন্ডিয়া টুডে-কে উপরোক্ত তথ্য জানান।
এ দিকে ভারতের হাইকমিশন বলেছে তারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সংস্পর্শে রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশের শীর্ষনেতাদের সঙ্গেও তারা কথা বলেছেন। হাই কমিশনার আরও বলেছেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের মতে এই বিবাদের কারণ হচ্ছে জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব।
সম্প্রতি মামলাটির একটি রায় প্রকাশিত হয়। যা একজন মামলাকারীর পক্ষে যায়। সে লোকজন নিয়ে ওই রায়কে কায়েম করার চেষ্টা করে।
বাংলাদেশ পুলিশ ও কর্তৃপক্ষ বলছ, কিছু ব্যক্তি ইসকন মন্দিরের সঙ্গে সংলগ্ন একটি জরাজীর্ণ প্রাচীর মেরামত করার জন্য ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। আর তা থেকেই গণ্ডগোলের সূত্রপাত। তবে মন্দির আক্রান্ত হয়নি এবং তাতে কোনও ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি।
বিষয়টি কলকাতার ইসকন মন্দিরের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমণ দাসের বক্তব্য গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশি হিন্দু ও হিন্দু উপাসনালয়ের সুরক্ষা নিয়েও অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েন।
এ-সম্পর্কে বিবিসি ঢাকায় অন্তর্তদন্ত করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
রিপোর্টটি এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছেn ‘ইসকন: ঢাকায় রাধাকান্ত জিউ মন্দিরে কথিত হামলায় আসলে কী ঘটেছে’। বিবিসি বলছে, ‘বাংলাদেশে পুরনো ঢাকার ওয়ারি এলাকায় একটি ইসকন মন্দিরে একদল দুষ্কৃতীকারী হামলা চালিয়ে সীমানা প্রাচীরের একটা অংশ ভেঙেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাধাকান্ত জিউ ইসকন মন্দির নামের এই মন্দিরের পুরোহিত অমানি কৃষ্ণ দাশ অভিযোগ করেছেন দুষ্কৃতীকারীরা আকস্মিকভাবে হামলা চালিয়ে মন্দিরের সীমানা প্রাচীর ভাঙার সময় প্রতিরোধ করতে গিয়ে পুরোহিতের দু’জন সহকারি আহত হয়েছে।
এই ঘটনার পিছনে জমি নিয়ে বিরোধের কথা বলা হয়েছে। হামলার ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বলেছে, মন্দিরের জমি নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহলের সঙ্গে বিরোধ থেকে এই হামলা হয়েছে।
এ দিকে স্থানীয় পুলিশ বলছে, হামলার অভিযোগ সঠিক নয়। জমির মালিকানা দাবিদার একটি পক্ষ সেখানে সংস্কার কাজ করার সময় পুরনো দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। তবে হামলার অভিযোগ ওঠার পর মন্দিরটিতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
পুরনো ঢাকার ওয়ারি এলাকায় লালমোহন সাহা স্ট্রিটে সাড়ে ১৬ কাঠা জায়গা নিয়ে এই মন্দির। এটি প্রায় দু’শো বছরের পুরনো মন্দির বলে দাবি করছে এর কর্তৃপক্ষ। তবে মন্দিরটিতে বৃহস্পতিবার আসলে কী ঘটেছে, সেই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে।
মন্দিরের পুরোহিত অমানি কৃষ্ণ দাশ বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর শ-দুয়েক লোক এসে মন্দিরের সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলে এবং মন্দিরের পুরোহিতের দুজন সদস্য প্রতিরোধ করতে গেলে হামলাকারীরা তাদেরও আক্রমণ করে। তিনি আরও অভিযোগ করেন, সীমানা প্রাচীর ভাঙার পর হামলাকারীরা মন্দির চত্বরে ঢুকে সেখানে থাকা একটি মূর্তি এবং নির্মাণ কাজের কিছু লোহার রড নিয়ে যায়।
কিন্তু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একটি (প্রতিনিধি) দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মন্দিরটির সীমানা প্রাচীরের একটি অংশ ভাঙা ব্যতীত মূর্তি অপহরণ বা লুটপাটের কোনও তথ্য পায়নি। ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মণীন্দ্র কুমার নাথ তাদের সংগঠনের ওই টিমের নেতৃত্বে ছিলেন।
তিনি বলেছেন, সেখানে পরিদর্শন করে তাঁরা শুধু দেখতে পেয়েছেন মন্দিরটির প্রাচীন জরাজীর্ণ সীমানা দেওয়ালের একটা অংশ হামলাকারীরা ভেঙেছে। সে-সময় বাধা দিতে গিয়ে পুরোহিতের দু’জন সহকারি আহত হয়েছেন। এ ছাড়া মন্দিরের ভেতরে হামলাকারীদের অন্য কোনও অঘটন ঘটানোর কোন তথ্য তাঁরা পাননি। কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, সে-ব্যাপারে অবশ্য সবপক্ষই জমি নিয়ে বিরোধের কথা বলেছে।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা মণীন্দ্র কুমার নাথ বলেছেন, স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যক্তি মন্দিরের জায়গার একটি অংশের মালিকানা দাবি করে আসছিলেন বেশ কয়েক বছর ধরে।
এ নিয়ে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে পুরনো মামলাটি। তিনি উল্লেখ করেন, জমির মালিকানা দাবিদার সেই ব্যক্তির লোকজন হামলা করে মন্দিরের সীমানা প্রাচীর ভেঙে জায়গা দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
মন্দিরটির পুরোহিত অমানি কৃষ্ণ দাশও জমি নিয়ে বিরোধের ব্যাপারে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু মন্দিরের ভেতরে কোন হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা পুরোপুরি অস্বীকার করেছে স্থানীয় পুলিশ।
ওয়ারি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবীর হোসেন বলেছেন, মন্দিরে হামলার অভিযোগ সঠিক নয়। এই দাবির সমর্থনে তিনি বলেন, মন্দির যে জায়গায় তার পাশে ভিন্ন হোল্ডিং নম্বরের আরেকটি জায়গা আছে। হাজী সফিউল্লাহ নামের এক স্থানীয় ব্যবসায়ী ওই জায়গার মালিকানা দাবি করেন।
এই পুলিশ কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, সেই ব্যক্তির লোকজন ধসে পড়া প্রাচীন দেওয়ালের কাছে সংস্কার করার সময় কিছুটা অংশ ভেঙে পড়ে। কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষ ওয়ারি থানা পুলিশের বিরুদ্ধে ঘটনার ব্যাপারে মামলা না নেওয়ার অভিযোগ করেছে। এই অভিযোগও অস্বীকার করেছেন ওয়ারি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মন্দিরের জমি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি এবং হামলার অভিযোগ যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে উঠেছে, তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। ট্যুইটারে মন্দিরে হামলার খবর
এ দিকে এই কথিত হামলার বিষয়ে ট্যুইটারে এক পোস্ট ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। ‘ভয়েস অফ বাংলাদেশি হিন্দুস হ্যান্ডেল থেকে সেই পোস্টে বলা হয়, মন্দিরে হামলা করে মূর্তি ভাঙচুর এবং লুটপাট করা হয়েছে এবং হামলা করা হয় বৃহস্পতিবার শবেবরাতের রাতে।
এর ওপর ভিত্তি করে ভারতের অনেক সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বৃহস্পতিবার রাতে শবেবরাত উদ্যাপনই হয়নি। এ ছাড়া মন্দিরের ভেতরে প্রতিমা ভাঙচুর কিংবা লুটপাটের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। সব পক্ষই বলেছে, ধর্মীয় চিন্তা থেকে নয়, জমি নিয়ে বিরোধ থেকে মন্দিরের সীমানা প্রাচীরের একটা অংশ ভাঙার ঘটনাটি ঘটেছে।’