আহমদ আবদুল্লাহ: বিপুল জনসংখ্যা-সমন্বিত মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দাদের ব্যাপক আবেদনের মুখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২১ সালে বহরমপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজের স্নাতকোত্তর বিভাগে পরিকাঠামো ব্যবহার করে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে। মুর্শিদাবাদ স্বাধীনতার পর থেকেই শিক্ষা ও আর্থিক উন্নয়নের দিক থেকে ব্যাপকভাবে পিছিয়ে ছিল। কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট আমলে মুর্শিদাবাদের উন্নয়ন হয়নি। বরং চিনিকল জাতীয় যে ক’টি শিল্প ছিল তাও বন্ধ হয়ে যায়। জেলাটিকে করে রাখা হয় শিল্পবিহীন বা নো ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত হলেও তা দুই-তিনটি বিভাগেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ফলে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় বিরাট আশা জাগিয়ে শুরু হয়।
কিন্তু বর্তমানে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় আরও উন্নতি করার পরিবর্তে বন্ধের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। একথা বলা হচ্ছে এই জন্য যে, নতুন পরিকাঠামো তো তৈরি হওয়া দূরের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, তাও এখন বন্ধ। ফলে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নামকাওয়াস্তে খাড়া রয়েছে। তার একটি অবয়ব থাকলেও তা প্রাণহীন হয়ে পড়ে রয়েছে। বাড়ছে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের হতাশা এবং সেইসঙ্গে দুর্দশাও।
২৭ সেপ্টেম্বর বুধবার মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র জেলার কর্তা ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এক স্মারকলিপি পেশ করেছে। আর তার অনুলিপি দেওয়া হয়েছে রাজ্যপাল ও শিক্ষামন্ত্রীকে। এই স্মারকলিপিতে লেখা হয়েছে, ১) ৪র্থ সেমিস্টারের ফলাফল দীর্ঘদিন পরও ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হচ্ছে না। ফলে এই ছাত্রছাত্রীরা কাঙ্খিত কোর্সে ভর্তি হতে পারছে না। তাদের ছাত্র জীবনের ভবিষ্যৎ সংকটের মধ্যে রয়েছে। স্মারকলিপিতে ছাত্রছাত্রীদের দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে, সরকার অনুমোদিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বা স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি সমাপ্ত হয়ে গেলেও মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তা শুরুই হতে পারেনি। তৃতীয় অভিযোগ, যেহেতু শিক্ষক ও পরিকাঠামো নেই, তাই বিভিন্ন বিভাগে এমএ-এর তৃতীয় সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হতে পারেনি।
ডিএম-কে প্রদত্ত স্মারকলিপিতে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আরও যে গুরুতর অভিযোগটি উত্থাপন করেছে তাহল, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই, রেজিস্টার নেই। নেই কন্ট্রোলারও। ফলে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় নামে চলছে বটে কিন্তু তা অনেকটা ড্রাইভার ও ইঞ্জিনবিহীন ট্রেনগাড়ির মতো। আর সেইসঙ্গে শত শত ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ এসে দাঁড়িয়েছে বিরাট প্রশ্নের মুখে।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ছিল সরকারি কলেজে বিএড-এ ভর্তির ফর্ম ফিলআপ করার শেষদিন। কিন্তু রেজাল্ট আটকে রাখায় মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিএড-এ ভর্তির আবেদনই করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুস্তাকিম মোল্লা জানালেন, আমরা শুধু ভাবছি এই শাস্তি আমাদের কেন দেওয়া হচ্ছে? যারা বেসরকারি বিএড কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করবে তারাও রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে না। এছাড়া ঐক্যশ্রী, বিবেকানন্দ, কন্যাশ্রীর মতো যে স্কলারশিপগুলি রয়েছে, তা পাওয়া তো দূরের কথা, আবেদনই করতে পারছে না মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দায়িত্বশীল কোনও আধিকারিক নেই। ফলে ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই স্থায়ী শিক্ষক, কর্মচারী। নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কোনও ব্যবস্থা।
মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়াচ্ছেন, তাঁদের-সহ ননটিচিং স্টাফ তথা ডেইলি-ওয়েজ কর্মীদের বেতন কয়েক মাস ধরে বন্ধ। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন, কাজ করছেন কিন্তু রোজগারের অভাবে সংসার অচল হয়ে পড়ছে।
মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ। শুধু দু-একটি বিভাগে কোনোক্রমে ক্লাস চালু হয়েছে বলে জানাল কয়েকজন ছাত্র। এই বিভাগগুলি হল ইংরেজি, বোটানি, এডুকেশন। বাকি বিভাগগুলিতে পড়াশোনায় চলছে অচলাবস্থা।
মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস এখনও হয়নি। নিজস্ব ভবন নির্মাণের কোনও কাজই শুরু হয়নি। তবে সমসাময়িক বোলপুরের বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে।
সবমিলিয়ে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কালো অন্ধকার নেমে এসেছে। নেই-এর তালিকা ক্রমশ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বন্ধ হয়ে গেছে পড়াশোনা। স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে কাউকে দেখার জন্য অধীর হয়ে রয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি কে দেখবেন, তা বুঝতে না পেরে পড়ুয়ারা দ্বারস্থ হয়েছে জেলাশাসকের। কিন্তু তিনিও বুঝতে পারছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কতটা নাক গলাবেন, না কি আদৌ গলাবেন না! বহু আশা জাগিয়ে নবাবী জেলা মুর্শিদাবাদে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা-প্রদীপ এখন নিভু নিভু।