পুবের কলম,ওয়েবডেস্ক: ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড। যা ইসলাম,খ্রিস্টান এবং ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের জন্য পবিত্রভূমি বা দি প্রমিস ল্যান্ড নামে পরিচিত। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, বিশ্বে ইহুদীদের নিজেদের কোনো দেশ ছিলো না। তারা চেয়েছিল নিজেদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। তাঁদের এই ইচ্ছায় ইন্ধন যোগায় ব্রিটিশরা।
১৮৯৭ সাল থেকে নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও বসতিস্থাপনের পর্যাপ্ত ভূখণ্ড পাচ্ছিলনা ইহুদীরা। তবে অন্ধকার রাস্তায় আলোর কিরণ খুঁজে পায় যখন বিশিষ্ট রসায়নবিদ ও ব্রিটেনের ইহুদী নেতা ‘চাইম উইজম্যান’ ফিলিস্তিনে প্রবেশ করেন। সালটা ১৯০৭। ‘চাইম উইজম্যান’ ইসরাইলের প্রথম রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে প্রথমেই তিনি জাফা এলাকায় কোম্পানি খোলেন।
জানান, এই এলাকায় আগামী তিন বছরের মধ্যে ইহুদি জাতীয় তহবিল তৈরি করা হবে। যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের উপনিবেশ স্থাপনের জন্য জমি কেনা যাবে। এই ঘোষণার পর ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনের নানা অংশে জমি ক্রয় করতে থাকে ইহুদীরা। যার জেরে মারজ বিন আমেরে ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত সহ হামাসের জড়িয়ে পড়া সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য নিন্মে উল্লেখ করা হল।
১৯১৭: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের অধিকারভুক্ত হয়। উক্ত সময়ে ফিলিস্তিনে মুসলিম ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অল্পসংখ্যক ইহুদী সেখানে বসবাস করতেন।
১৯২০-১৯৪০: ১৯২০-র দশক থেকে ১৯৪০-র দশকে ফিলিস্তিনে লাফিয়ে-লাফিয়ে ইহুদি অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছিল। যাঁরা মূলত হিটলারের গণহত্যার জেরে ইউরোপ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে দুই গোষ্ঠীর (ইহুদি ও আরবীয়) মধ্যে সংঘাত আরও বাড়তে শুরু করেছিল। জোরালো হয়ে উঠতে শুরু করেছিল সমস্যা। সেই সঙ্গে ইহুদীদের জন্য আলাদা দেশ গড়ে তোলার দাবিও ক্রমশ ত্বরান্বিত হতে শুরু করেছিল। পরে রাষ্ট্রসংঘ এবং ব্রিটেনের সাহায্যে অবৈধভাবে গড়ে ওঠে ইসরাইল।
১৯৪৭-১৯৪৮: ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রসংঘে দেশভাগের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। তাতে ঠিক হয়েছিল যে ব্রিটিশদের হাতে থাকা ফিলিস্তিনকে দু-ভাগে ভাগ করা হবে। একটি দেশ হবে ইহুদীদের জন্য। অন্যটি আরবীয়দের। তবে সেই পরিকল্পনা ঘিরে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। সঙ্গে-সঙ্গেই যুদ্ধ বেঁধে যায়। যে যুদ্ধে সামিল হয়েছিল প্রতিবেশী একাধিক আরব দেশ। অন্যদিকে ইহুদীদের প্রকৃত ভূখণ্ড কি হবে সেই সমস্যা মেটানোর আগেই ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটিশরা। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইলি রাষ্ট্র ঘোষণার কথা জানান ইহুদীরা। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ইহুদীদের ছল-চাতুরি ঠাহর করতে পেরে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ফিলিস্তিনি আরবরা। ১৫ মে উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে আন্দোলন শুরু হয়। দীর্ঘ ৮ মাস ওই যুদ্ধ চলে। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্রিটিশ সৈন্য এবং ইহুদী নাগরিকদের কড়া টক্কর দেন। কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে ব্রিটিশ সৈন্যরা। একদিকে শুধু আরব দেশ অন্যদিকে পশ্চিমাদের সমর্থনে ফুলে ফেঁপে ওঠা ইসরাইল।
১৯৪৯ সালে প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ইসরাইল জয়ী হয়েছিল। অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিন নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন বা তাঁদের উৎখাত করা হয়েছিল। একাধিক রিপোর্ট অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট সময়ে ৭.৫ লক্ষ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। যে ঘটনাকে ‘আল নকবা’ বা বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
ফিলিস্তিনিদের ইসরাইলমুক্ত করার জন্য ১৯৬৪ সালে পিএলও অর্থাৎ ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন গঠন করা হয়। তাতেও কোনও সমাধা হয়নি। ফেরেনি শান্তিও। বরং অত্যাচারী ইহুদীদের অত্যাচার মাত্রারিক্ত বেড়ে গিয়েছিল।
১৯৬৭: ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিবেশি আরব রাষ্ট্রগুলোর যে কয়টি যুদ্ধ বেঁধেছিল তার মধ্যে ১৯৬৭ সালের তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছয় দিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধে ইসরাইল নাটকীয়ভাবে তিনটি আরব রাষ্ট্রকে পরাজিত করে এবং জেরুজালেম, পশ্চিম তীর, গাজা এবং গোলান মালভূমিসহ সম্পূর্ণ ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে নেয়।
১৯৭৩: ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মিশর ও সিরিয়া ও বিবিধ আরব দেশগুলি সম্মিলিতভাবে ইসরাইলে হামলা চালায়। ইহুদীদের উৎসবের দিন সেই হামলা চালিয়েছিল সম্মিলিত দেশগুলি। আচমকা আক্রমণে ইসরাইল কিছুটা দিশাহারা হয়ে যায়। সে দেশের তৎকালীন প্রধামমন্ত্রী গোল্ডা মেয়র আমেরিকার কাছে সাহায্য চান। প্রথম দিকে তা দিতে রাজি হয়নি আমেরিকা। যদিও, সিরিয়া ও মিশরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল রাশিয়া। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আপৎকালীন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। শেষে আমারিকার মদতে আরবদেশগুলিকে হারিয়ে দেয় ইসরাইল।
১৯৭৪: রাষ্ট্রসংঘের হাত ধরে ফিলিস্তিনকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি ইহুদীদের জন্য রাষ্ট্র গঠন হয়। অন্যটি আরবীয়দের জন্য।
১৯৭৮ সালে মিশরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার শাদাত , ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জিম্মি কার্টার সম্মিলিতভাবে শান্তি চুক্তির কথা জানান। যা ডেভিড অর্কাড নামে পরিচিত।
১৯৮২ সালের ৬ জুন দক্ষিণ লেবাননে দখল করে ইসরাইল। উক্ত সময়ে বহু ফিলিস্তিনি নিহত হন।
১৯৮৭ সালে প্রথম ইত্তিফাদা সূচনা হয়। ‘ইত্তিফাদা ‘ হল একটি আরবি শব্দ। অর্থ নাড়িয়ে দেওয়া। যে শব্দ ১৯৮৭ সাল থেকে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হতে থাকে। একটি মহলের বক্তব্য, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজায় ইসরাইলের উপস্থিতির বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ গড়ে তোলা হয়, তা ব্যাখ্যা করতেই ‘ইত্তিফাদা’ শব্দ ব্যবহার করেন ফিলিস্তিনরা। প্রথম ‘ইত্তিফাদা’ শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। চলেছিল ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত।
১৯৯৩ সালে অত্যন্ত গোপনে ইসরাইল এবং পিএলওর মধ্যে অসলো শান্তিচুক্তি প্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। অনেক মতানৈক্যর পর শেষমেশ এ চুক্তি সই হয়। যদিও এ চুক্তির কার্যক্রম ২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনের ব্যর্থতা ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার (গণঅভ্যুত্থান) পরে ভেঙে যায়।
২০০০-২০০৪: দ্বিতীয় ‘ইত্তিফাদা-র সূচনা হয়েছিল ২০০০ সাল। চলেছিল ২০০৫ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় ‘ইত্তিফাদা’ সমাপ্ত হওয়ার পরেও ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনদের সংঘাত কমেনি। একাধিক মহলের দাবি, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নিজেদের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়াতে থাকে ইসরাইল। আবার হামাস, ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মতো ফিলিস্তিনি সংগঠন প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
২০০৬: ৩৮ বছর দখলদারী চালানোর পর গাজা ত্যাগ করে ইসরাইল। তখন হামাস নির্বাচনে জয়ী হয়। আশির দশকের শেষলগ্নে তৈরি হলেও নব্বইয়ের দশকে স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তির (ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের মধ্যে হয়েছিল) বিরোধিতা করে মূলত উত্থান হয়েছিল হামাসের। বেড়েছিল গুরুত্ব।) একাধিক রিপোর্ট অনুযায়ী, হামাসের বক্তব্য ছিল, শান্তিচুক্তিতে যে দ্বিরাষ্ট্র তত্ত্বের কথা বলা হয়েছে, তাতে ফিলিস্তিনের মানুষদের অধিকার খর্ব হবে।
২০০৮: ফিলিস্তিনি ফোর্স ইসরাইলে হামলা চালায়। এই ঘটনায় ১১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। অন্যদিকে ১৩ ইসরাইল নিহত হয়েছিল।
২০১২: উক্ত সালে হামাসের আহমদ জাবারি হামাসের মিলিটারি প্রধানকে খুন করেন। প্রতিশোধ নিতে গাজা ইহুদী বসতী লক্ষ্য করে রকেট ছাড়ে। এই ঘটনায় ৬ জন ইসরাইল ও ১৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন।
২০১৪: হামাস যত শক্তিশালী হয়েছে, তত ইসরাইলের সঙ্গে সংঘাত বেড়েছে। দু’পক্ষের সবথেকে ভয়াবহ সংঘাত হয়েছিল ২০১৪ সালে। ৫০ দিনের যুদ্ধে প্রায় ১,৫০০ সাধারণ নাগরিক-সহ ২,৩০০ জন প্যালেস্তাইনির মৃত্যু হয়েছিল। ইসরাইল ৬৭ জন জওয়ান এবং ছয়জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল।
২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেন। ২০১৮ সালে বিভিন্ন ঘটনার জেরে বিক্ষোভ শুরু করে ফিলিস্তিনিরা। যার জেরে ১৭০ বিক্ষোভকারীকে খুন করে ইসরাইলি বাহিনী।
২০২১ সালের মে’তে জেরুসালেমর আল-আকসা চত্বরে ইসরাইল বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ঘে কয়েকশো ফিলিস্তিনি আহত হয়েছিলেন। আল-আকসা থেকে ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে গাজা থেকে ইসরাইলে পরপর রকেট হামলা চালিয়েছিল গাজা। ১১ দিনের যুদ্ধে প্রায় ৩০০ জন মারা গিয়েছিলেন।