বিধুরা এস টেনিকুন: শ্রীলঙ্কায় চরমে অর্থনৈতিক সংকট। গত কয়েক বছর ধরে এই দেশের সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছিল। ইউক্রেন-সংকট এই দ্বীপরাষ্ট্রকে বিপদের একেবারে মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মার্কিন ডলারের নিরিখে শ্রীলঙ্কার রুপির মূল্য অনেকটাই কমে গিয়েছে। বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি এখন দুই সংখ্যার ঘরে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে তীব্র নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে এবং সমস্যার কিনারে দাঁড়িয়ে টলমল করছে এই দেশ। এর ফলস্বরূপ, বিদ্যুতের ঘাটতি এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্বালানি, খাদ্য ও ঔষধের যেগুলির বেশিরভাগটাই আমদানি করা হয়, অভাব দেখা দিয়েছে এবং এগুলির দাম এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে সাধারণ শ্রীলঙ্কাবাসীর নাগালের বাইরে চলে গেছে। এমনকি মুদ্রণের কাগজেরও জোগান নেই এবং এর ফলে স্কুলগুলিকে পরীক্ষা বাতিল করতে হচ্ছে। এই সংকটে বিক্ষুব্ধ জনতা যেভাবে আন্দোলন করছে তেমনটা গত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। বিদ্রোহীদের দমন করতে সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা এখন বিদেশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সাহায্যের প্রত্যাশায়। তাকিয়ে রয়েছে তাদের দুই বৃহত্তম বাণিজ্যিক মিত্রের দিকে। চিন এর আগে ২.৮ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। আরও ২.৫ বিলিয়ন দেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে বিবেচনা করছে তারা। ভারত ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কাকে দিয়েছে ২.৪ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক প্যাকেজের জন্য এই দেশের রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষ সরকার এখন আন্তর্জাতিক মনিটারি ফান্ড ও ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের সঙ্গে বার্তালাপ চালাচ্ছে। যদিও এর আগে তিনি এই সংস্থাগুলির থেকে অর্থ সাহায্য নিতে চাননি। কারণ তার জন্য নানারকম শর্ত মেনে চলতে হয়। অর্থনীতিবিদ ও শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের প্রাক্তন আধিকারিক হিসাবে আমি সরাসরি এমন অনেক নীতি দেখেছি যা আজকের এই সংকটকে সৃষ্টি করেছে। আর এখন, এশিয়ার প্রাচীনতম গণতন্ত্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সুস্থিতি ঝুঁকির মুখে। সরকার যদি না দীর্ঘস্থায়ী কোনও সমাধান বের করে তাহলে এই বিপদ আরও ব্যাপক আকার নেবে।
ব্যাপক বৃদ্ধি
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল শ্রীলঙ্কা। সাম্প্রতিককালে ২৬ বছর ধরে চলা ভয়াবহ ও ব্যয়বহুল গৃহযুদ্ধ থেকে উঠে এসেছে তারা। সংখ্যাগুরু সিংহলীদের এই দেশে সরকারি সেনার সঙ্গে সংখ্যালঘু তামিলভাষী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যুদ্ধ চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। সাধারণ মানুষ ও তাদের সম্পত্তিকে লাগাতার নিশানা করা হয়েছে।
২০০৬ সালে, এই যুদ্ধের শেষ দিকে, বিদেশি পুঁজি এনে এবং বিপুল পরিমাণে ঋণ নিয়ে সরকার অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিল। স্বল্প মেয়াদের জন্য এই কৌশল খেটেছিল। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়। ২০০৬ সালে মাথাপিছু গড় দেশি পণ্য ১৪৩৬ ডলার থেকে লাফিয়ে ২০১৪ সালে হয় ৩৮১৯ ডলার। শ্রীলঙ্কা এক ধাক্কায় টপকে যায় ইউক্রেন, ফিলিপিন ও ইন্দোনেশিয়াকে। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পায় ১৬ লক্ষ মানুষ যা এই দেশের জনসংখ্যার ৮.৫ শতাংশ। এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশের উত্থান হয়। ২০১৯ সালের মধ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ‘উচ্চ মাঝারি আয়ে’র দেশের তালিকায় উপরের দিকে স্থান দখল করে নেয় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই উচ্চতা মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়েছিল, কারণ ওই সমস্ত বৃদ্ধি এসেছিল অনেক মূল্য চুকিয়েই। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ ২০০৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে তিনগুন বেড়ে যায় এবং মোট পাবলিক ঋণ দাঁড়ায় জিডিপির ১১৯ শতাংশ। ২০১৫ সালে কিছু সময়ের জন্য ওই নীতিগুলি বাতিল করা হয়েছিল যার ফলে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে যায়, কিন্তু সুস্থিতি ফিরে আসে। তবে, ঋণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
অতিমারি ও যুদ্ধ
এরপরই কোভিড-১৯ অতিমারি আছড়ে পড়ে। যে-পর্যটকরা ২০১৮ সালে ৫.৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করে শ্রীলঙ্কার ১০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক ঘাটতিতে ভারসাম্য আনায় বড় ভূমিকা পালন করেছিল, তারা রাতারাতি উধাও হয়ে যায়। এর ফলে অর্থনীতি ব্যাপক ধাক্কা খায়, বিশেষত অতিমারির আগের বছর বড়সড় ছাড় দেওয়া হয়েছিল আয়করে। ওই বিপুল ঋণের বোঝা বইতে গিয়ে ২০২০ সালে সরকারের আয়ের ৭২ শতাংশ চলে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে ছাপতে হয় আরও মুদ্রা এবং এইভাবে মুদ্রাস্ফীতির পরিবেশ ঘনিয়ে ওঠে। সরকার ও নাগরিকদের সৌভাগ্য যে, প্রবাসী শ্রীলঙ্কানরা বছরে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়ে ক্ষীণভাবে হলেও বাঁচিয়ে রাখে এখানকার অর্থনীতিকে। কিন্তু ২০২১ সালে যখন বহু অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক আন্তর্জাতিক সাহায্য নিতে পরামর্শ দেয় শ্রীলঙ্কাকে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক পাখির চোখ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে ঋণ নেওয়াকেই। শ্রীলঙ্কার রুপির মূল্য ধরে রেখে ও আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে তারা এই নীতি ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করে যায়।
অতিরিক্ত রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন রান্নার গ্যাস, দুধ প্রভৃতির ঘাটতি দেখা দেয়। শ্রীলঙ্কার বিদেশি রিসার্ভে যে মুদ্রা রয়েছে তা যাতে বেরিয়ে না যায় সে-দিকে নজর দেওয়া হয়। তাছাড়া, রুপির কালোবাজারি মূল্য পড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্সও কমতে শুরু করে।
ফলস্বরূপ, মানুষ মার্কিন ডলার থেকে সরকারি দামে বা সরকারি পথে শ্রীলঙ্কান রুপিতে অর্থ রূপান্তরিত করতে অনীহা প্রকাশ করে।
বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৫৫ শতাংশের কাছাকাছি হলেও সরকার জানায় এই মুদ্রাস্ফীতি ১৪ শতাংশ। মার্চের মধ্যে ইউক্রেনে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে এবং তেল, গম ও অন্যান্য পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য বেড়ে যায়। সরকার অবশেষে তাদের নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। আমদানিকৃত পণ্যের দামের উপর প্রভাব ছাড়াও যুদ্ধের প্রভাব পড়ে শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্পের উপরও, কেননা মস্কো যাওয়ার উড়ান এখন বাতিল করা হয়েছে। যুদ্ধের আগে, শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্পে সিংহভাগ অর্থ আসত রুশ পর্যটকদের কাছ থেকে। ইউক্রেনও পিছিয়ে ছিল না।
বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি
শ্রীলঙ্কা নিজেদের অর্থনীতি বাঁচাতে যে নীতি গ্রহণ করেছে তা খেটেও যেতে পারে, কিন্তু শ্রীলঙ্কাবাসীদের এর মূল্য চোকাতে হবে দীর্ঘদিন ধরে। দুধ, কমলালেবু ও গৃহস্থালীর নানা জিনিস সহ ৩৫০টির বেশি ‘অ-আবশ্যকীয়’ পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পণ্যের জোগান হ্রাস পেয়েছে এবং তার পরিমাণও সীমাবদ্ধ। সেই কারণে প্রতিদিন এগুলির দাম বাড়ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রান্নার গ্যাসের দাম পাঁচ মাস আগে যা ছিল তার চেয়ে তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মনিটারি ফান্ড ও ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ঋণ, সেই সঙ্গে চিন ও ভারতের স্বল্পমেয়াদি টাকা শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করে তুলতে পারে। কিন্তু আন্দোলন যেভাবে বাড়ছে এবং নেতারা যেভাবে নানা দাবি তুলছেন তাতে এই সরকারের জনপ্রিয়তা দ্রুত নিঃশেষিত হচ্ছে। বেশিদিন তাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন হতে পারে।