পুবের কলম,ওয়েবডেস্ক: দ্বিতীয় দফার ভোটের পর থেকে সম্পূর্ণভাবে মেরুকরণের পথে হাঁটতে শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একেবারে সরাসরি মুসলিমদের নিশানা করতে শুরু করে দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মুসলিমদের বিরুদ্ধে এতটা আক্রমণাত্মক হতে আগে দেখা যায়নি। আর এবার প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা কাউন্সিল একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশে মুসলিমদের জনসংখ্যা হু-হু করে বেড়েই চলেছে। তুলনায় হিন্দুদের জনসংখ্যা কমছে। আর মোদির কাউন্সিলের প্রকাশ করা এই রিপোর্টকে হাতিয়ার করে ভোট ময়দানে নেমে পড়েছে বিজেপি। তারা বলতে শুরু করেছে, এমনটা চলতে থাকলে ভারতে আর কোনও হিন্দু থাকবে না। ভারত নাকি ‘পাকিস্তান’ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় দফা ভোট শেষ হতেই হটাৎ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাচনী প্রচারসভাগুলি থেকে মুসলিমদের নিশানা করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, কংগ্রেস বলেছিল দেশের সম্পদের উপর মুসলিমদের অধিকার সকলের আগে। অর্থাৎ দেশের সম্পদ বন্টন করা হবে তাদের মধ্যে, যাদের পরিবারে বেশি সন্তান রয়েছে। অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে দেশের সম্পদ। কংগ্রেসের ইস্তেহারেই বলা হয়েছে, মা-বোনদের সোনার গয়নার হিসেব করে সেই সম্পদ বিতরণ করা হবে। দেশের সম্পদে অধিকার মুসলিমদেরই। আপনাদের মঙ্গলসূত্রটাও বাদ দেবে না। শুধু তাই নয়, মোদি আরও বলেন, কংগ্রেস চায় এসসি, এসটি ও ওবিসি’র থেকে কোটা কেটে ‘জিহাদি’ ভোট ব্যাঙ্কের হাতে তুলে দেওয়া। এখানেই শেষ নয়, সম্প্রতি, আবার তিনি বলেছিলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে বাবরি মসজিদের তালা রামমন্দিরে লাগিয়ে দিবে। এই ধরনের একের পর এক মন্তব্য তিনি মুসলিমদের নিশানা করে বলে চলেছেন। যদিও শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি সহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের তিনি এসবের বাইরে রেখেছেন। আর তৃতীয় দফা ভোটের পর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা প্যানেল যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, দেশে মুসলিমদের সংখ্যা নাকি বেড়েই চলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আর্থিক উপদেষ্টা কাউন্সিলের ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অংশীদারিত্ব, আন্তঃদেশীয় বিশ্লেষণ’ শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ৬৫ বছরে দেশে মোট জনসংখ্যার নিরিখে হিন্দুদের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতে জনসংখ্যা বিচার করলে ১৯৫০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারতে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে ৭.৮২ শতাংশ। সেইসময়ের মধ্যেই মুসলিমদের জনসংখ্যা ৪৩.১৫ শতাংশ বেড়েছে। খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং শিখদের জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে হিন্দুদের পাশাপাশি পার্সি এবং জৈনদের জনসংখ্যা কমেছে। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৫০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বৌদ্ধ মানুষের সংখ্যা বেশ বেড়েছে। মোট জনসংখ্যার নিরিখে ২০১৫ সালে যেখানে ০.০৫ শতাংশ বৌদ্ধ মানুষ ছিলেন, ২০১৫ সালে সেটা বেড়ে ০.৮১ শতাংশে ঠেকেছে। তবে কমে গিয়েছে জৈন এবং পার্সি জনসংখ্যা। ১৯৫০ সালে মোট জনসংখ্যার নিরিখে যথাক্রমে ০.৪৫ শতাংশ এবং ০.০৩ শতাংশ জৈন এবং পার্সি মানুষ ছিলেন। যা ২০১৫ সালে কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ০.৩৬ শতাংশ এবং ০.০০৪ শতাংশে। ১৯৫০ সালে মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৮৪.৬৮ শতাংশ মানুষ হিন্দু ছিলেন। যা ২০১৫ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৭৮.০৬ শতাংশে। আবার ১৯৫০ সালে মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৯.৮৪ শতাংশ মুসলিম মানুষ ছিলেন। সেটা ২০১৫ সালে বেড়ে ১৪.০৯ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে।
হিন্দু, মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মের জনসংখ্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আর্থিক উপদেষ্টা কাউন্সিলের একটি রিপোর্টকে হাতিয়ার করে কংগ্রেসকে আক্রমণ শানাল বিজেপি। অমিত মালব্য দাবি করলেন যে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে ভারতে আর কোনও হিন্দু থাকবে না। তিনি আরও বলেন, বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি সেলের প্রধান। তিনি বলেন, ‘১৯৫০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার নিরিখে ভারতে হিন্দুর সংখ্যা ৭.৮ শতাংশ কমে গিয়েছে। অন্যদিকে, মুসলিমের সংখ্যা বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। দশকের পরে দশক ধরে কংগ্রেসের শাসনের ফলে এটাই হয়েছে। ওরা এলে দেশে কোনও হিন্দু থাকবে না।’ যদিও এই রিপোর্টের সমালোচনা করেছেন, বিহারের আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব। তিনি বলেন, ‘‘আপনি কীভাবে এই ধরনের একটি সংখ্যায় পৌঁছেছেন কোনও সেনসাস বা আদমশুমারি ছাড়াই? ২০২১ সালে আদমশুমারি করা হয়নি। আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী… দয়া করে আপনি এই হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ত্যাগ করে দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলি নিয়ে কথা বলুন। প্রধানমন্ত্রী বা বিজেপি কেউই ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলবেন না। বিহারকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কথা বলবেন না প্রধানমন্ত্রী। মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার সমাজে ফাটল সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারা সংবিধান পরিবর্তন করতে চায়। আমরা বিভাজনকারী শক্তিকে সমাজে ফাটল সৃষ্টি করতে দেব না।’’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হটাৎ ভোটের মধ্যে কেন এই ধরনের রিপোর্ট পেশ করতে হল? ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ নিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়নি তো? বিশেষকরে প্রধানমন্ত্রী যখন নাগাড়ে একটি সম্প্রদায়কে নিশানা করে চলেছেন তখন এই ধরনের একটি রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।