গোলাম রাশিদ: দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে এক অকূল সমুদ্রের মধ্যে পড়েছিল। তৈরি হয়েছিল বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা। ইসলামি আদর্শ অনুযায়ী মুসলিম সমাজকে দিশা দেখানোর মতো তেমন কোনও পত্রিকাও ছিল না। এই প্রেক্ষিতে নাসির আহমেদের সম্পাদনায় ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হল ‘মীযান’ পত্রিকা। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পথচলা শুরু করেছিল এটি। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পত্রিকাটি উপস্থিত হয়েছে সুবর্ণ জয়ন্তীতে। রবিবার পার্ক সার্কাসের ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন প্রেক্ষাগৃহে বিশিষ্টদের স্মৃতিচারণা, সংবর্ধনা প্রদানের মধ্যে দিয়ে উদ্যাপিত হল সাপ্তাহিক মীযানের পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। বক্তাদের ভাষণে উঠে এল মীযান-এর প্রথম দিকের ইতিহাস, এর পথ চলা, আদর্শ ও লক্ষ্যের কথা। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের গ্রন্থাগার ও জনশিক্ষা প্রসার মন্ত্রী মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী, মীযান-এর প্রাক্তন সম্পাদক ডা. রইসউদ্দিন ও মুহাম্মদ নূরুদ্দিন শাহ, মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান, বাংলা ইসলামি প্রকাশনী ট্রাস্টের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রফিক, মাওলানা এএফএম খালিদ, মাওলানা তাহেরুল হক, মীযান-এর বর্তমান সম্পাদক ডা. মসিহুর রহমান, বাংলা ইসলামি প্রকাশনী ট্রাস্টের সেক্রেটারি রহমত আলি খান প্রমুখ।
লেখালেখি, সাংবাদিকতার পিছনে আদর্শ প্রচারের তাগিদ লুকিয়ে থাকে। থাকে সুষ্ঠু মূল্যবোধ ও নৈতিকতা প্রসারের উদ্দেশ্য। প্রচলিত ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে কোনও ঘটনাকে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করাটাও জরুরি। কিয়ামতের দিনে আল্লাহ্ স্থাপন করবেন ন্যায়বিচারের তুলাদণ্ড বা মীযান। এই পত্রিকাটিও মানুষের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করে চলেছে। এদিন বক্তারা জানান, মীযান এই কাজটিই শুরু থেকে করে আসছে। বাংলায় মুসলিম সমাজকে নৈতিক দিশা দেখানোর কাজ করেছে এই পত্রিকা। মীযান-এর সম্পাদক ডা. মসিহুর রহমান তাঁর ভাষণে মীযান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জানান, ‘মুসলিম সমাজকে ইসলামি আদর্শ ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ করাই মীযান-এর লক্ষ্য। বিভিন্ন ধর্ম, ভাষার দেশে আমরা বাস করছি। এই দেশের প্রতি আমাদের কর্তব্য আছে। দেশের কল্যাণ, উন্নতির জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। এখানে কোনও সংকীর্ণতার অবকাশ নেই। দেশ ও জাতিকে পথ দেখানোর জন্যই এই মীযান পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়েছিল। বাংলায় মুসলিমদের যে-সমস্ত দৈনিক বা সাপ্তাহিক কাগজ রয়েছে, সেখানকার লেখক-সাংবাদিকদের তৈরিতেও মীযান-এর ভূমিকা রয়েছে।’
পুবের কলম-এর সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান জানান স্কুল ম্যাগাজিনের বাইরে প্রথম যে পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, সেটি ছিল ‘মীযান’। সেই অতীত দিনের স্মৃতিচারণ করে ইমরান বলেন, ‘লেখক-সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এসে একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে নিবন্ধ লিখেছিলেন। তাতে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে কী লাভ হল? সেখানে তো ওরা এখনও আরবি নামই রাখছে। ‘বাঙালি’ নাম তো রাখছে না। আসসালামু আলাইকুম বলছে। আমি ওঁর এই নিবন্ধের একটি জবাবি লেখা মীযান-এ লিখেছিলাম যুক্তি ও তথ্য দিয়ে। মুসলিমদের বাঙালি হতে হলে আরবি নাম ত্যাগ করতে হবে কেন? কাজী নজরুল, বেগম রোকেয়া কি কম বাঙালি? এভাবেই প্রশ্ন তুলেছিলাম।’
১৯৭৩ সালে যখন মীযান-এর পথচলা শুরু হয় তখন এর সঙ্গে ইমরান জড়িত ছিলেন। স্মৃতিচারণে সেসব কথা ছাড়াও উঠে আসে নুরুল ইসলাম খান, ফাত্তাহ সাহেব, জাফর সাহেব, আলাউদ্দিন মোল্লা, আবুল হাসানের নাম। পাশাপাশি এদিন ইমরান তাঁর বক্তব্যে মুসলিম বিরোধী প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ™ত্রপত্রিকার গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মীযান-এ প্রথম থেকেই আমরা নানা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়েছি। আমাদের নয়া প্রজন্ম সোনালি ইতিহাস ভুলে যাচ্ছে। শের-ই-বঙ্গাল এ কে ফজলুল হক, রোকেয়াকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। পত্রিকার মাধ্যমে আমাদের শিকড়ের ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইসলামের অবদান নিয়ে আলোচনা সামনে আনতে হবে। এভাবেই ইসলাম বিরোধী অপপ্রচার রুখতে পত্রিকা বড় ভূমিকা নিতে পারে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।
রাজ্যের মন্ত্রী মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমাদের ভালো-মন্দের হিসেব লিখে চলেছেন দুই ফেরেশতা–‘কিরামান কাতিবিন’ বা সম্মানিত লেখকদ্বয়। এভাবে লিখিত বিষয়ের উপরে আল্লাহ্ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই পত্রিকারও গুরুত্ব রয়েছে সমাজে। এখন সমাজ চাইছে ঐকমত্যের কথা। চাইছে এগিয়ে চলার বার্তা। বিতর্কের কথা সমাজ চাইছে না। গঠনমূলক লেখার প্রচণ্ড অভাব। পত্রিকাগুলিকে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে বলে তিনি পরামর্শ দেন। পাশাপাশি গাজার প্রসঙ্গ টেনে ইসরাইলি পণ্য বয়কটেরও আহ্বান জানান মন্ত্রী।
সাহিত্যিক মুহাম্মদ নূরুদ্দিন শাহও তাঁর বক্তব্যে ফিলিস্তিনে চলমান ইসরাইলি গণহত্যার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বিশ্বের ইতিহাসে এত কম দিনে এত বেশি সংখ্যক সাংবাদিককে হত্যা করার নজির নেই। গাজায় সেটা করছে ইসরাইল। এই সাংবাদিকদের অপরাধ কী? তারা সত্য প্রকাশ করছে। যে সাহিত্য মানুষের জীবনকে নষ্ট করে, যে সাহিত্য মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ বাড়িয়ে দেয়, বাজারে তার কদর আছে। আর যারা সত্য বলবে, তাদের জন্য বন্দুকের গুলি অপেক্ষা করছে। আমরা মীযানকে সত্য বলার জন্য গড়ে তুলতে চেয়েছি সবসময়।
মাওলানা আবদুর রফিক বলেন, সাপ্তাহিক মীযান ইসলামি দৃষ্টিকোণ ও মূল্যবোধ থেকে খবর পরিবেশন ও বিশ্লেষণ করে চলেছে ৫০ বছর ধরে। ডা. রইসউদ্দিন জানান, মীযান মুসলিম মিল্লাতের মুখপত্র হয়ে উঠুক, আমরা এমনটাই চেয়েছিলাম। প্রাক্তন বিআইপিটি সম্পাদক নাসিম আলি বলেন, মীযান সংগ্রাম ও আন্দোলনের অপর নাম। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নির্ভীক ভাবে লড়াই করছে এই পত্রিকা।
এই অনুষ্ঠানে মুসলিম সমাজের বহু বিশিষ্ট সম্পাদক ও বুদ্ধিজীবী উপস্থিত হয়েছিলেন—অধ্যাপক মেহেদি হাসান, এমদাদুল হক নূর, এস এম সিরাজুল ইসলাম, সেখ নাসিরউদ্দিন, ড. মুস্তাফিজুর রহমান, জয়নূল আবেদিন, মতিউর রহমান, আবুল হাসান, আবু সালেহ রেজাওয়ানুল করিম, জাইদুল হক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।