বিশেষ প্রতিবেদন: বিগত দুই বছর ধরে করোনা মহামারির তাণ্ডবে পরিবারের আয় কমেছে। কারণ করোনার কারণে বহু পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হয়তো চাকরি হারিয়েছেন, নয় তার বেতন কমেছে।
আর্থিক সংকটে অনেক উচ্চবিত্ত পরিবার তাদের সন্তানদের বেসরকারি স্কুলের পরিবর্তে সরকারি স্কুলে স্থানান্তর করতে বাধ্য হচ্ছে। শিক্ষার বার্ষিক অবস্থা (আসের)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, করোনা মহামারির সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছে গ্রামীণ অঞ্চলগুলির শিক্ষাব্যবস্থায়। দীর্ঘ সময় ধরে লকডাউনের কারণে স্কুলগুলির পড়াশোনার মান কমেছে। প্রায় ৩০ শতাংশ অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া দ্বিতীয় ক্লাসের পাঠ্যবই ঠিকমতো পড়তে পারে না। ৫৫ শতাংশ পড়ুয়া অঙ্ক ঠিকমতো পারে না। বলা যায়, করোনা মহামারির লকডাউনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিক্ষাব্যবস্থায়। খারাপ খবরের পাশাপাশি কিছু ভালো ঘটনাও ঘটেছে।
দেশের বিভিন্ন সরকারি স্কুলে আগের চেয়ে অনেক বেশি শিশু, বিশেষ করে মেয়েরা ভর্তি হয়েছে। তবে উচ্চ শ্রেণীতে পাঠরত অনেকেই এখনও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুদের জন্য নির্ধারিত পাঠ্য বই পড়তে অক্ষম।
২০২২ সালের ‘আসের’ রিপোর্ট অনুসারে, চার বছরের মহামারিতে দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার প্রভাব পড়েছে পড়ুয়াদের জীবনে। কারণ সকল শিক্ষার্থী যে অনলাইন ক্লাসের সুবিধা নিতে পেরেছে তা নয়। প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে নেট সমস্যার পাশাপাশি একটি মোবাইল থেকে একসঙ্গে পড়ুয়াদের পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি। বলা যায়, করোনা মহামারির মারাত্মক কু প্রভাব পড়েছে সমাজে। সব থেকে বিপর্যস্ত হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা।
কেন্দ্র সরকার যেখানে বলছে, শিক্ষাব্যবস্থায় ডিজিটাল যুগ চলে এসেছে, কিন্তু সেখানে প্রকান্তরে দেখা যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা ধুঁকছে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১২ সালে জাতীয় স্তরে শিক্ষার যে মান ছিল, সেখানেই আবার পৌঁছে যাচ্ছে।
‘আসের’ সংস্থার ডিরেক্টর উইলিয়াম ওয়াধওয়া জানিয়েছেন, ভারতে এতদিন ধরে স্কুল বন্ধের ইতিহাস কোনও সময় হয়নি। বর্তমানে বিশ্বে লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার মান পড়ে গেছে।
গ্রামীণ অঞ্চলের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালে পাঠ্য বই যারা ঠিকমতো পড়তে পারে না সেই শতাংশ ছিল ২০.৫, সেই পরিসংখ্যান ২০২২ সালে ২৭.৩ শতাংশে নেমে গেছে। সেইভাবে পঞ্চম শ্রেণীর ছেলে-মেয়েদেরও একই অবস্থা। ঠিক মতো দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তক পড়তে পারে না তারা। ২০১৮ সালে এই শতাংশ ছিল ৪২.৮ শতাংশ সেটি ২০২২-এ নেমে এসেছে ৫০.৫ শতাংশে।
তিনটি রাজ্যে শিক্ষার মান ১৫ শতাংশ কমেছে। এই তিনটি রাজ্য হল অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত ও হিমাচল প্রদেশ। ১০ শতাংশ কমেছে উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, হরিয়ানা, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রে।
প্রথম এডুকেশন্যাল ফাউন্ডেশনের প্রধান রুক্মিণী ব্যানার্জি বলেছেন, যে দক্ষতা তাদের অর্ধেক বছরের মধ্যে হওয়ার কথা ছিল, সেই জায়গায় পৌঁছতে গিয়ে দু থেকে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময়ে ঘরে বন্দি থাকার ফলে পড়ুয়াদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা, গতি কমেছে। স্কুলে গেলে যে নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে জীবন চলছিল তারও একটা ছন্দপতন ঘটেছে। এছাড়াও পাশ না করলেও ক্লাসে উঠে যাব, সেই মনোভাবও চলে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত চারবছরে সরকারি স্কুলগুলিতে যেমন ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে, তেমনি স্কুলগুলিতে মোটা টাকা ডোনেশনের জন্য বেসরকারি স্কুলের ভর্তি থেকেও পিছু হঠতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকেরা।
রুক্মিণী ব্যানার্জি জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে সরকারি স্কুলে ভর্তির হার ছিল ৬৫ শতাংশ, ২০২২ সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ভালো খবর হল, ২০১১ সালে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির সংখ্যা ছিল ১৩ লক্ষ, সেখানে ২০২০ সালে ২২ লক্ষে পৌঁছেছে।
জাতীয়স্তরে শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক হল সমস্ত স্তরে স্কুলে যাওয়া মেয়েদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৬ সালে ১১ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে ১০.৩ শতাংশ মেয়েরা এখনও স্কুলের বাইরে। ২০১৮ সালে ৪.১ শতাংশ মেয়েরা স্কুলে যায় না, তাদের বয়স হল ১১ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে। ২০২২ সালে মাত্র ২ শতাংশ মেয়ে স্কুলে যায় না। আর উত্তরপ্রদেশে মাত্র ৪ শতাংশ মেয়ে এখনও স্কুলের বাইরে।