বিশেষ প্রতিবেদক: দেশভাগের পর আমাদের অনেক কিছুই পালটে গেছে। বহু গুরুত্বপূর্ণ ও সমাজে অবদান রাখা ব্যক্তিবর্গের কোনও স্মৃতি আমরা সংরক্ষণ করার চেষ্টা করিনি। বিশেষ করে মুসলিম সমাজের ব্যক্তিবর্গের। বেগম রোকেয়া, এস ওয়াজেদ আলি, স্যার আজিজুল হক, ডা. হাসান সোহরাওয়ার্দি, সলাউতুন নেসা, বেলেঘাটার তাঁর নির্মিত মসজিদ প্রাঙ্গণে কবরটি জবরদখল হয়ে রয়েছে। সলাউতুন নেসা পবিত্র মক্কার প্রথম আনুষ্ঠানিক মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন। ছিলেন শিক্ষাপ্রেমী দানশীল মহিলা জমিদার। দু’দিন পরে কিন্তু তাঁর কবরটির আর চিহ্ন থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহে রয়েছে, তালিকাটি ক্রমশই দীর্ঘায়িত হতে থাকবে।
এবার শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে নয়, এশিয়ায় যাকে ‘দন্ত চিকিৎসার জনক’ বলা হয়, সেই ডা. রফিউদ্দিন আহমেদের স্মৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে সমাজের অবদান নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। ডা. আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের পিছন দিকে ছোট একটি গলি রাস্তাকে তাঁর নামাঙ্কিত করা হয়েছে।
ডা. আর. আহমেদ ডেন্টাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালটি তিনি নিজের অর্থ ব্যয়ে তৈরি করেছিলেন। প্রথমে তিনি ৬ বিঘা জমি ক্রয় করেন মৌলালি মোড়ের কাছে ১১৪ নম্বর এজেসি রোডে এবং সেখানেই তিনি নিজ অর্থে ডেন্টাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের জন্য বিল্ডিং তৈরি করেন।
আর সেখানেই এখনও কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল চলমান রয়েছে। এই ডেন্টাল কলেজটি তাঁর নামে করা হয় যখন তিনি এই জমি, বিল্ডিং, ডেন্টাল সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্র, সহ পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিনা শর্তে হস্তান্তর করেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডা. বিধানচন্দ্র রায়। তিনি ঘোষণা করেন, ‘ক্যালকাটা ডেন্টাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল’ এবার থেকে ‘ডক্টর রফিউদ্দিন আহমেদ’ নামে পরিচিত হবে। তারপর থেকেই এই কলেজ অ্যান্ড হসপিটালটি আর. আহমেদ ডেন্টাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল নামে সারা ভারত নয়, সারাবিশ্বে পরিচিত।
তিনি স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ও পশুপালন দফতরের মন্ত্রীর দায়িত্বও সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত করে। সেই সময় পদ্মভূষণ পাওয়া ছিল এক বিরল সম্মান। এ ছাড়াও তাঁর আরও অনেক অবদান রয়েছে। তাঁর কর্মভূমি ছিল মূলত কলকাতা। তাঁর খ্যাতি এতটাই বিস্ত+ত ছিল যে, তৎকালীন বোম্বে-ভিত্তিক উপমহাদেশের বিখ্যাত আইনজীবী পরে পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ’র বোন ফাতিমা জিন্নাহ দন্ত চিকিৎসা অধ্যয়ন করতে কলকাতায় এসে তাঁর কলেজে ভর্তি হন।
সে যাই হোক, ডা. রফিউদ্দিন আহমেদ ইন্তেকাল করেন ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। তাঁর কবরটি কলকাতার ৩ নম্বর গোবরা কবরস্থানে রয়েছে। কিন্তু এখন এক কথায়, এই কীর্তিমান মানুষটির কবর ‘ছিনতাই’ হতে চলেছে।
এই কবরটির স্থান খরিদ করেছিলেন ডা. আর আহমেদ স্বয়ং। ডা. রফিউদ্দিন আহমেদের কবর হচ্ছে ব্লক নম্বর ৯, রো নম্বর ৫। কবরের নম্বরও হচ্ছে ৫। সংলগ্ন কেনা জমি ৬-তেও রয়েছে কবরের স্থান। আর এখানে কবর দেওয়া হয়েছে ডা. আর আহমেদের স্ত্রী, কন্যা এবং তাঁর এক পুত্রবধূকে। কবরস্থান কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সমস্ত জমিটি বাউন্ডারি ওয়াল দ্বারা চিহ্নিত রয়েছে। কবর কেনার সমস্ত রেকর্ড, রেজিস্ট্রিকৃত দলিল সবকিছুই ডা. আর আহমেদ সাহেবের জামাতা মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ ও তাঁর নাতি ড. জাহিদ আহমেদ এবং নাতনি ডা. জরিনা আলিয়ার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
ডা. জরিনা আলিয়ার কথায়, আমরা হঠাৎই ২০১৮ সালের মে মাসে কবরস্থানে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার নানাজান ডা. আর আহমেদের নাম লিখিত যে ফলক ছিল, তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর সেই জায়গায় ডা. আর আহমেদের কবরে একটি ফলক লাগানো হয়েছে ‘আনোয়ারা খাতুন’ মৃত্যু ‘১৯৭৫’।
ডা. জরিনা আলিয়া আরও বলেন, কলকাতার কবরস্থানসমূহের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা ‘মোহামেডান বারিয়াল বোর্ড-এর নিকট বেশকিছু চিঠি জমা করি এবং সাক্ষাৎ করেও কবরের পরিচিতি পালটে দেওয়া সম্পর্কে জানাই। অনুরোধ করি ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু বিগত বছরগুলিতে কোনও ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। আমরা প্রমাণপত্র সমস্ত কিছু দাখিল করেছি। মোহামেডান বারিয়াল বোর্ডের কার্যালয় স্বীকারও করেছে, আমাদের দাখিল করা ডকুমেন্ট বা দলিলপত্রই সঠিক এবং তারা পুরনো নথি পরীক্ষা করে যা পাচ্ছেন, তা আমাদের পেশ করা তথ্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু হলে কী হবে! মোহামেডান বারিয়াল বোর্ড নিষ্ক্রিয়ই রয়েছে। কিন্তু কেন, তা আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।
ডা. জরিনা আলিয়া আরও বলেন, আমার নানা ইন্তেকাল করেছিলেন ১৯৬৫ সালে। আর আনোয়ারা খাতুন ইন্তেকাল করেন ১৯৭৫ সালে। কিন্তু কেন এভাবে বাংলা ও ভারতের একজন কৃতিপুরুষের কবরকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, তা সত্যিই রহস্যজনক।
আমরা মরহুম ডা. আর আহমেদ-এর কবরটিকে ‘হেরিটেজ’ আখ্যা দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। ডা. জরিনা আলিয়া এবং তাঁর ভাই ড. জাহিদ আহমেদ দুজনেই বলেন, আমরা বারিয়াল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং কলকাতা কর্পোরেশনের কমিশনার বিনোদ কুমার সাহেবকে বহুবার বলেছি। কিন্তু তিনি কোনও ব্যবস্থা নেবেন বা ইনসাফ করবেন, এমন কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। আর. আহমেদের নাতনি ডা. জরিনার চোখে তখন নীরব অশ্রুর ফোঁটা।