আহমদ হাসান ইমরান: হঠাৎই দেশে মুসলিমদের সম্পর্কে নানা ধরনের ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচারে মেতে উঠেছে একদল লোক। আর গত দুই-তিন বছরে তা তুঙ্গে উঠেছে। এরসঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে শাসক দল বিজেপিও। বিজেপির মুখপাত্রী নূপুর শর্মা হযরত মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে খুবই ঘৃণ্য ও অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। পরে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বিজেপির শিল্পপতি সদস্য নবীন জিন্দাল।
বর্তমানে ভারতীয় মুসলিমদের আত্মমর্যাদা ও হিম্মত ভেঙে দেওয়ার জন্য যে ভরপুর চেষ্টা হচ্ছে, তা সবাই জানে। সামান্য অজুহাতে বুলডোজার দিয়ে মুসলিমদের বাড়ি, ঘর, দোকানপাট গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য আইন-আদালত কোনও কিছুরই পরোয়া করা হচ্ছে না। মুসলিম মেয়েদের হিজাব খুলতে একরকম বাধ্য করা হচ্ছে। প্রতিটি মসজিদে পুরনো মন্দির ও শিবলিঙ্গ আবিষ্কৃত হচ্ছে! এমনকী শেষপর্যন্ত সংঘ পরিবারের গুরু মোহন ভাগবতকেও অস্বস্তি নিয়ে বলতে হয়েছে,’সব মসজিদে শিবলিঙ্গ খোঁজার দরকার কি!’ ফলে রাসূল মুহাম্মদ সা.-র বিরুদ্ধে অযথা কুবাক্য উচ্চারণ করলে ভারতের মুসলিমরা মৌখিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। দু-একটি স্থান ব্যতীত রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেনি।
কিন্তু প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছে মুসলিম বিশ্বে, বিশেষত আরব দুনিয়ায়। এটা ভারতে অনেকে আশা করেনি। আর বিজেপি শাসিত নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার তো নয়ই। হঠাৎই দেখা গেল, বিশ্ব মুসলিমের পথপ্রদর্শক রাসূল মুহাম্মদ সা.-র অবমাননায় বেশ কয়েকটি আরব দেশ প্রবল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
রিয়াদের প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিক ‘আরব নিউজ’-এর ভাষায়n সউদি আরব, উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলি ও মুসলিম সংস্থাসমূহ ভারতের শাসক দলের কর্মকর্তারা নবী মুহাম্মদ সা.-র প্রতি যে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন, তার প্রবল নিন্দা জানিয়েছে। অনেকেই দাবি করেছে, এই ইসলামোফোবিয়া বন্ধ করার জন্য ভারতকে বিবৃতি দিলেই চলবে না, বরং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।
সউদি আরব ইদানীং অনেক বিষয়েই নীরব থাকার ভূমিকা পালন করছিল। সেই সউদিও এবার কিন্তু মুখ খুলেছে। রিয়াদ ভারতীয় জনতা পার্টির মুখপাত্রের কদর্য মন্তব্যকে ‘অপমানজনক’ বলে বিবৃত করেছে এবং সেইসঙ্গে সউদি পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, ভারতের উচিত হবে সমস্ত ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা। আরও অগ্রসর হয়ে সউদি বিদেশ দফতর বলেছে, ইসলামের স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত এই সম্মানীয় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে পূর্ব ধারণার বশবর্তী হয়ে মন্তব্যকে সউদি আরব স্থায়ীভাবে প্রত্যাখ্যান করছে এবং সমস্ত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও প্রতীকের প্রতি বিদ্বেষকে নস্যাৎ করছে।
সব থেকে বড় কথা, কয়েকটি দেশ কাতার-কুয়েত- ইরান-পাকিস্তান-ওমানের বিদেশ দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ক্ষেত্রবিশেষে মন্ত্রী স্বয়ং ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া নিন্দা ব্যক্ত করেছেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার ৭৫ বছরের মধ্যে আরব দেশগুলির এই ধরনের আচরণের কোনও নজির পাওয়া যায় না। উপরন্তু ভারতের বন্ধু দেশ মালদ্বীপ, বিশ্বের সবথেকে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া মিশরের প্রাচীন ও বিখ্যাত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় আল আজাহারও খুবই কঠোর ভাষায় ভারতের নিন্দা করেছে।
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-র প্রতি বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মার অবমাননার বক্তব্য গালফ-এর দেশগুলির শাসকবর্গ এবং সাধারণ মানুষকে এতটাই ক্ষুব্ধ ও ক্রোধান্বিত করেছে যে, তারা বন্ধু ভারতের প্রতি এক নজিরবিহীন আচরণে লিপ্ত হয়েছে। ভারতের উপরাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যান বেঙ্কাইয়া নাইডু আনুষ্ঠানিকভাবে কাতার সফর করছিলেন। কাতারের আমির তাঁর সঙ্গে প্রথামতো বৈঠক করেছেন। কিন্তু তারপরই আসে একটি অপ্রত্যাশিত আঘাত। আর তা হল, কাতারের ডেপুটি আমিরের সঙ্গে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট বেঙ্কাইয়া নাইডুর একটি ব্যাঙ্কোয়েট লাঞ্চ হবে বলে স্থির ছিল। ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্টের সম্মানে এই লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু তা আচমকাই বাতিল করে দেওয়া হয়। বিষয়টি ভারত-কাতার দুই দেশের সম্পর্কের জন্য খুবই বেদনাদায়ক বলে বিবেচিত হয়েছে। এ দিকে কুয়েতের সহকারী বিদেশমন্ত্রী ভারতের রাষ্ট্রদূত সিবি জর্জ-এর হাতে একটি কূটনৈতিক প্রতিবাদপত্র তুলে দিয়েছেন।
কুয়েত, কাতার, সউদি আরব ছাড়াও ইরান, ওমান প্রভৃতি দেশও নবীর নিন্দাকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে এবং নয়াদিল্লির কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ ছাড়াও রবিবার রাতের দিকে মুসলিম দেশগুলির জোট সংগঠন ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন’ এবং পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রণালয় আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করার জন্য ভারতের কাছে তীব্র নি¨াসমন্বিত লিখিত কূটনৈতিকপত্র পেশ করেছে। ভারত শুধু ওআইসি ও পাকিস্তানের বক্তব্যের জবাব দিয়েছে। কিন্তু অন্য দেশগুলির ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করা হতে বিরত রয়েছে।
ভারতের বিদেশ দফতর অবশ্য নিজেদের একটি বক্তব্যকে বারবার তুলে ধরছে। আর তা হল ‘আমরা সকল ধর্ম সম্পর্কেই শ্রদ্ধা পোষণ করি।’ এ দিকে ভারতের আরও বিপদ হচ্ছে, সউদি আরব-সহ গালফ দেশগুলিতে ৭৫ লক্ষের বেশি ভারতীয় কর্মরত রয়েছেন। তাঁরা দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান। সেইসঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক ভারতীয় এই দেশগুলিতে রোজগার খুঁজে নেওয়ায় ভারতে বেকারত্বের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও প্রচুর সহায়তা হয়েছে।
ভারতীয়রা এসব দেশগুলিতে প্রচুর ব্যবসাও প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন্য একটি সমীক্ষার হিসেবে জানা যায়, উপসাগরীয় দেশগুলিতে বিভিন্ন কাজে ভারতের প্রায় ৯ মিলিয়ন লোক কর্মরত রয়েছেন। উপসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদি বেশ সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে তাই মন্দির নির্মাণের অনুমতিও পাওয়া গেছে। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে ভারতের মসজিদগুলিকে জঙ্গি গেরুয়াপন্থীরা মন্দিরে পরিণত করার পায়তারা করছে তাতে এই সৌহার্দ্য বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
এই কথা বলেছেন স্বয়ং রাজপরিবারের এক প্রিন্সেস। সবমিলিয়ে যদি ইসলাম ও নবী নিন্দা এবং ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ না হয়, তাহলে বিদেশি প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অর্থ ও বিদেশ নীতি নয়া বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। আর সারাবিশ্বে ভারতের ভাবছবি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।