সেখ কুতুবউদ্দিন
রাজ্য সরকার আইন পাস করলেও নানা কায়দায় ওবিসি সংরক্ষণ এড়িয়ে যাচ্ছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক সময় খানিকটা চালাকি করে যাতে পড়ুয়া ভর্তিতে ওবিসি-এ (প্রধানত মুসলিম)দের সংখ্যা হ্রাস পায় সেই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এই নিয়ে ছাত্র-ছাত্রী ও বিশিষ্ট মহল ক্ষুব্ধ। ইতিমধ্যে রাজ্য অনগ্রসর দফতরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন– সম্পূর্ণ সংরক্ষণ মানার নির্দেশ রয়েছে। তবে কেন মানছে না? সেই বিষয়ে শিক্ষা দফতরকে জানানো হয়েছে। কেউ অভিযোগ জানালে সংশ্লিষ্ট দফতরকে পুনরায় বলা হবে। তবে অভিযোগ উঠেছে– স্নাতক– স্নাতকোত্তরের ভর্তির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ বিধি পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে– ওবিসি-র কাট অফ মার্কস ইতিহাস-সহ বেশ কিছু বিষয়ে জেনারেল ক্যাটাগরির কাট অফ মার্কসের থেকে বেশি। এটা বাস্তবে অসম্ভব না হলেও কার্যত চরম অন্যায়। এর আগে কখনও হয়নি। নির্দেশিকা অনুসারে ওবিসি প্রার্থীরা এমন কোনও ছাড় পায়নি– যাতে তাদের কাট অফ জেনারেলের থেকে বেশি হতে পারে। তবে কেন তাদের কাট অফ মার্কস জেনারেল শ্রেণির থেকেও বেশি রাখা হচ্ছে।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চালাকি ও কায়দা করে আবেদনের সময় ওবিসি প্রার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছিল– তারা জেনারেল এবং ওবিসি দুটি ক্যাটাগরিতেই যদি সুযোগ পায় তাহলে তারা কোন দিকে যাবে? প্রার্থীরা বুঝতে না পেরে অনেকেই ওবিসি ক্যাটাগরি সিলেক্ট করেছে। তবে যাঁরা ওবিসিতে সিলেক্ট করেছেন– তারা সকলে মেরিট অনুসারে জেনারেল ক্যাটাগরিতে সুযোগ পেতেন। নিয়ম হচ্ছে– মেরিট অনুসারে জেনারেলে ঢুকতেই পারে।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলা যায়– যদি কেউ জেনারেল এবং ওবিসিতে দুটোতেই সুযোগ পায়– তাহলে সেই প্রার্থী কোন ক্যাটাগরিকে সিলেক্ট করবে। যেটা হয়েছে– ওবিসিদের ওবিসিতেই বরাদ্দ করে জেনারেল সিট গুলি ফাঁকা রাখা হয়েছে। ওবিসিতে ইতিহাস বিভাগে ক্যাম্পাস সহ শ্যামসুন্দর কলেজে মোট আসন ১৫ এবং ২টি মিলে মোট ১৭টি। এতে দেখা যাচ্ছে ওবিসি- এ কাট অফ যেটা হয়েছে– সেটা জেনারেল ক্যাটাগরির কাট অফ থেকে বেশি। যেটা সাধারণত হওয়া সম্ভব নয়। নির্দেশিকায়– ওবিসি ক্যাটাগরিতে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ৪৫ শতাংশ নম্বর পেলে সেও আবেদন করতে পারবেন। তবে জেনারেলের আবেদনের ক্ষেত্রে নম্বর ৫০ শতাংশ। ওবিসি সুবিধা যারা পাবে– তারা ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। তাই কোনও ওবিসি প্রার্থী সংরক্ষণের নম্বর ছাড়ের সুবিধা নেই নি। তারা সকলে জেনারেল ক্যাটাগরিতে যোগ্য। পাশাপাশি ওবিসি ক্যাটাগরিতে সিলেক্ট করা প্রার্থীরা সকলেই জেনারেল কাট অফ মার্কস পার করেছে। অনেক ওবিসি প্রার্থী জেনারেল ক্যাটাগরিতেও উচ্চ নম্বরের আধিকারি প্রার্থী– তবুও তাঁদের ওবিসিতেই আবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে জেনারেল থেকে ওবিসি প্রার্থীদের কাট অফ মার্কস বেশি হয়ে গিয়েছে। সরকারি সংরক্ষণ নিয়ম অনুসারে ওবিসি- এ ১০ শতাংশ সংরক্ষণ পেত প্রার্থীরা– সেটাও উধাও করে দেওয়া হয়েছে। ওবিসিতে সিলেক্ট হওয়া প্রার্থীরা যদি জেনারেল ক্যাটাগরি হিসেবে আবেদন করতেন– প্রত্যেক প্রার্থীরা অসংরক্ষিত আসনেও সুযোগ পেতেন। তাই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে দেখা যাচ্ছে ওবিসি-এ সংরক্ষণ শূন্য।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে– সংরক্ষিত তালিকার কাট অফ অসংরক্ষিত তালিকার কাট অফ -এর থেকে বেশি। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়– হোম ইউনিভারসিটির ৮০ শতাংশ কোটা অনুসারে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মেধা তালিকায় ওবিসি-এ -এর কাট হল ৭৬.৭ শতাংশ। ওবিসি-বি এর কাট অব হল ৭৭.২ শতাংশ। কিন্তু অসংরক্ষিত তালিকার কাট অফ করা হয়েছে ৭৫.৬ শতাংশ। যেটা দুটি সংরক্ষিত তালিকা থেকেই কম। নিয়মানুসারে এটা হওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। ফলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে কার্যত কোনও সংরক্ষণ হয়নি।
২০১৪ সালে পাশ হওয়া সংরক্ষণ বিলে বলা হয়েছে– রাজ্য সরকার পরিচালিত এবং অনুমোদিত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ কর্তৃপক্ষকে সংরক্ষণ নিয়ম ২০১৪-১৫ সাল থেকে কার্যকর করতে হবে। নিয়মে বলা হয়েছে– কোনও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ৩৮টি আসন থাকে– তাহলে ২২ শতাংশ হারে ৮টি আসন এসসি– ৬ শতাংশ হারে ২টি আসন এসটি– ১০ শতাংশ হারে ৪টি আসন ওবিসি-‘এ’ এবং ৭ শতাংশ হারে ৩টি আসন ওবিসি ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ভর্তি করতে হবে। ৩৮টি আসনের মধ্যে বাকি ২১টি সিট অসংরক্ষিতদের জন্য রাখতে হবে।
বিলের ৪ নম্বর রুলের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে– প্রতিটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সাল থেকে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে সংরক্ষণ পুরোপুরি কার্যকর করতে হবে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত আসন বাড়ানোর মেয়াদ দেওয়া হয়েছিল। অথচ বিলে বলা হয়েছে– উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আসন বাড়ানোর জন্য রাজ্য সরকারের কাছে ‘ডিটেল প্রজেক্ট রিপোর্ট’-এর মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠাতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই আসন বাড়ানোর জন্য কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ। আসন না বাড়ানোয় ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ম কার্যকরে পুরোপুরি গাফিলতি রয়েছে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। বিল অনুসারে– কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিকাঠামোর অভাব দেখালে– তারও বিস্তারিত শিক্ষা দফতরে পাঠাতে হবে। শিক্ষা দফতরের পরিকাঠামো পূরণ করার চেষ্টার মাধ্যমে আসন বাড়াতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলিকে। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সেই চেষ্টায় করেনি বলে শিক্ষা দফতরের এক সংরক্ষণ আসনগুলিতে কোন কোন গ্রাউন্ডে ভর্তি নিচ্ছে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান– তার জন্য কোর্স অনুসারে ‘রেজিস্ট্রার মেইনটেন’ করতে হবে। ৯ নম্বর রুলে বলা হয়েছে– কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কীভাবে সংরক্ষণ নিয়ম কার্যকর করেছে– সেই তথ্য বিস্তারিতভাবে ‘জয়েন্ট কমিশনার ফর রির্জারভেশন’কে পাঠাতে হবে। কিন্তু রাজ্য অনগ্রসর দফতর জানিয়েছে– এই সংরক্ষণে তাদের কোনও ভূমিকা নেই। শিক্ষা দফতর কার্যকর করে। তাদের কাছে অভিযোগ আসলে শিক্ষা দফতরে পাঠায় মাত্র। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষণ নিয়ম কার্যকরের ক্ষেত্রে অনগ্রসর দফতর– শিক্ষা দফতর এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষদের গাফিলতি– বাহানা– কারসাজি কেন? তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে।
নেতাজি সুভাষ ওপেন ইউনিভারসিটির অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইনতাজ আলি বলেন– প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসসি–এসটি– ওবিসিদের আলাদা সেল থাকে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেলে থাকা সদস্যদের সংরক্ষণ বিষয় কার্যকর হচ্ছে কী না তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো উচিত। পাশাপাশি শিক্ষা দফতরের নজরে আনা প্রয়োজন।
আইআইটি বোম্বে-এর গবেষক আসিফ আকরাম বলেন– বর্ধমান এবং কাজী নজরুল সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় চালাকি এবং বিভিন্ন ভাঁওতাবাজির মাধ্যমে ওবিসি– অন্যান্য সংরক্ষণ কার্যত তুলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ফর্মের মধ্যে জটিলতা তৈরি করে প্রার্থীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে সমস্ত সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। এই বিষয়ে ভর্তির শুরু থেকেই অনগ্রসর দফতর যাতে নজর রাখতে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সকলকে।
সংখ্যালঘু ছাত্র কাউন্সিলের রাজ্য সম্পাদক মুহাম্মদ নাজমুল আরেফিন বলেন– সংরক্ষণ নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কখনই সংরক্ষণ বিধি উপেক্ষা করতে পারে না। এই নিয়ে রাজ্য সরকারকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে ওবিসি নিয়ম কার্যকর দেখভালের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা উচিত। এই নিয়ে আমরাও মু্খ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হব।
সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন– কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি উচ্চ শিক্ষা দফতরের সমস্ত বিধি কার্যকর করছে– কিন্তু সংরক্ষণ নিয়ম সম্পূর্ণভাবে মানছে না।